ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

পাচার হওয়া সেই নদীই এখন মানবপাচার চক্রের হোতা

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২২ জুন ২০২১, ১৬:৫০  
আপডেট :
 ২২ জুন ২০২১, ১৮:১৬

পাচার হওয়া সেই নদীই এখন মানবপাচার চক্রের হোতা
আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের মূলহোতা নদীসহ সাতজন গ্রেপ্তার।

পাচার হওয়া নদীই এখন আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের বাংলাদেশ অঞ্চলের সমন্বয়ক। সাধারণ নারীর পরিচয়ের আড়ালে তার রয়েছে ভয়ঙ্কর রূপ। অনেক ভাষায় পারদর্শী এই নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে ভারতে গ্রেপ্তার টিকটক হৃদয় বাবুসহ চক্রের অন্য সদস্যদের। সঙ্গীদের নিয়ে পানশালায় পার্টিতে মশগুল থাকতেন নদী।

এছাড়া ভারত, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই পর্যন্ত তার জাল বিস্তৃত। ভালো চাকরিসহ নানা প্রলোভন দিয়ে বিভিন্ন দেশে নারী পাচার চক্রের অন্যতম সদস্য নদী। একেক দেশে তার একেক নাম। পাচার করার পর মেয়েদের তদারকি করতে প্রায়ই বিদেশ ভ্রমণ করেন তিনি।

পুলিশের ভাষ্যা, ১০টি নামের তথ্য পাওয়া গেছে নদীর। প্রতিটি দেশে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রে তার আলাদা নাম রয়েছে। নামগুলোর মধ্যে রয়েছে, ইতি ওরফে জয়া আক্তার, জান্নাত ওরফে নূর জাহান।

মঙ্গলবার রাজধানীর শ্যামলীর ডিসি কার্যালয়ে এ তথ্য জানান তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ। তিনি বলেন, যশোর সীমান্ত এলাকা থেকে মানবপাচারে জড়িত অভিযোগে নদীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ।

গ্রেপ্তাররা হলেন- নদী আক্তার ওরফে ইতি ওরফে নুরজাহান ওরফে জয়া (২৮), আল আমিন হোসেন (২৮), সাইফুল ইসলাম (২৮), আমিরুল ইসলাম (৩০), পলক মণ্ডল (২৬), তারিকুল ইসলাম (২৬), বিনাশ শিকদার (৩৩)।

উপ-কমিশনার শহিদুল্লাহ বলেন, ২০০৫ সালে সন্ত্রাসী রাজীব হোসেনের সঙ্গে নদীর বিয়ে হয়। ২০১৫ সালে রাজীব ‘গোলাগুলিতে’ মারা যাওয়ার পর মালয়েশিয়া পাচার হয়ে যায় নদী। এরপর থেকেই পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সে। পাচার হওয়া ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে নদীর দশটির মতো নাম পাওয়া যায়।

রাজধানীর শ্যামলীতে ডিসি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ।

গ্রেপ্তার এই চক্রটির সঙ্গে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া ‘হৃদয় বাবু’ ও ‘সাগরদের’ ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ পাওয়া গেছে জানিয়ে উপ-কমিশনার শহিদুল্লাহ বলেন, এক নারীকে তার স্বামী ৪০ হাজার টাকায় এই নদীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল।

তিনি বলেন, এ চক্রের সদস্যরা পাচারের উদ্দেশ্যে আনা মেয়েদেরকে যশোর সীমান্তের একটি বাড়িতে রাখত। পরে সুযোগমতো ভারতে পাচার করত। পাচারকৃত প্রত্যেক মেয়ের জন্য স্থানীয় এক ইউপি সদস্য এক হাজার টাকা করে নিতেন। পাচারকালে কোনো মেয়ে বিজিবির কাছে আটক হলে সেই ইউপি সদস্য তাকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতো।

তেজগাঁওয়ের এই ডিসি আরো বলেন, পাচার হওয়া নারীদের কাছে সে নদী হিসেবে পরিচয় দিলেও ভারতে তাকে সবাই ইতি নামে চেনে। ভারতীয় আধার কার্ডে তার নাম জয়া আক্তার জান্নাত। বাংলাদেশি পাসপোর্টে তার নাম নূরজাহান। সাতক্ষীরা সীমান্তে তার নাম জলি, যশোর সীমান্তে সে প্রীতি নামে পরিচিত।

পুলিশ বলছে, পাচারের উদ্দেশ্যে আনা মেয়েদেরকে যশোর সীমান্তে একটি বাড়িতে রেখে সুযোগমতো ভারতে পাচার করত চক্রটি। পাচারকৃত প্রত্যেক মেয়ের জন্য স্থানীয় এক ইউপি সদস্য এক হাজার টাকা করে নিত। পাচারকালে কোনো মেয়ে বিজিবির কাছে আটক হলে সেই ইউপি সদস্য তাকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতো।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসায় গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দি

গ্রেপ্তার আল আমিন হোসেন পাচারের উদ্দেশ্যে আনা মেয়েদেরকে তার বাড়িতে রেখে সুযোগমতো ভারতে পাচার করত। সে নারী পাচারের পাশাপাশি মাদক ব্যবসায় জড়িত। তার নামে যশোরের শার্শা থানায় দুটি মাদক মামলা রয়েছে।

গ্রেপ্তার পলক মন্ডল পঞ্চগ্রাম স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে আয়ুর্বেদিক ডিগ্রি নিয়ে চিকিৎসা শুরু করে। বেনাপোলের ইসরাফিল হোসেন খোকন, ভারতে অবস্থানকারী বকুল ওরফে খোকন, তাসলিমা ওরফে বিউটি ও চক্রের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে পলকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা নিতে আসা গ্রাম্য দরিদ্র মেয়েদেরকে ভারতের বেঙ্গালুরুতে তাসলিমার কাছে পাঠানোর মাধ্যমে পলকের নারী পাচারে হাতেখড়ি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা মেয়েদেরকে আধার কার্ড প্রস্তুত করে দেয়ার পাশাপাশি ‘সেফ হোম’ এ অবস্থান এবং বেঙ্গালুরুতে নির্ধারিত স্থানে পাঠানোর দায়িত্ব নেয় সে।

এছাড়াও সে ভারতীয় আধার কার্ড ও ভারতের নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত আইডি কার্ডধারী। সে উত্তর প্রদেশের গোরাক্ষপুর জেলার বড়ালগঞ্জ থানার নেওয়াদা গ্রামেও থেকেছে। তার কাছ থেকে ভারতীয় আধার কার্ড, দেশটির নির্বাচন কমিশনের দেয়া আইডি কার্ডসহ আয়কর বিভাগ কর জব্দ করা হয়েছে।

গ্রেপ্তার বিনাশ সিকদার বেনাপোলে বাসা ভাড়া নিয়ে পাসপোর্ট ফরম পূরণের কাজ করতেন। তার স্ত্রী সোনালী সিকদার ভারতীয় নাগরিক। বেনাপোলে পাসপোর্ট ফরম পূরণের কাজ করতে গিয়ে ইসরাফিল হোসেন খোকন, আব্দুল হাই সবুজ ও মানবপাচারে জড়িত আরো কয়েকজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে মানবপাচারে জড়িয়ে পড়ে বিনাশ।

যশোর ও নড়াইল থেকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে উচ্চ বেতনে চাকরি বা প্রলোভন দেখিয়ে আনা নারীদেরকে ইসরাফিল হোসেন খোকন, আল আমিন, তরিকুল, আমিরুল ও আরো কয়েকজনের মাধ্যমে সীমান্ত পার করে ভারতীয় দালালদের কাছে পৌঁছে দিতো বিনাশ।

গ্রেপ্তাররা ভারতে আধার কার্ড ও অন্যান্য সুবিধা কিভাবে পেয়েছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিসি শহিদুল্লাহ বলেন, এগুলো তৈরিতে ভারতীয় লোকেরা সহায়তা করেছে। গ্রেপ্তারদের সঙ্গে সেখানকার (ভারতীয়) দের ভালো যোগাযোগ আছে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এফজেড/ওয়াইএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত