ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

দিল্লি যখন জ্বলছিল পুলিশ তখন কোথায় ছিল?

দিল্লি যখন জ্বলছিল পুলিশ তখন কোথায় ছিল?

শুরুটা হয়েছিল রোববার বিকেলে। চার দিন পর বুধবার দিনের শেষেও স্বাভাবিক হয়নি রাজধানী দিল্লির পরিস্থিতি। প্রশ্ন উঠছে দিল্লিতে সহিংসতার সময় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। সেই প্রশ্নেরই জবাব খোঁজার চেষ্টা করছে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম আনন্দবাজার।

১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯: সিএএ, এনআরসি, এনপিআর, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব-সহ একাধিক ইস্যুতে শাহিন বাগের রাস্তায় ধর্নায় বসেন জনা পঞ্চাশেক মহিলা। ধীরে ধীরে শত শত মানুষ সেখানে ভিড় জমাতে থাকেন। সন্তান কোলে নিয়ে রাত ভর ধর্নায় শামিল হতে শুরু করেন অন্য এলাকার মহিলারাও। তাদের পাশে দাঁড়াতে সেখানে আনাগোনা বাড়ে কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি (আপ) এবং বিভিন্ন বামপন্থী দলের।

গত দু’মাস ধরে ‌শাহিন বাগে রাস্তা আটকে বিক্ষোভ চলছে। তার জেরে দিল্লি-নয়ডা এবং ফরিদাবাদ যাওয়ার মূল রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে রয়েছে। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নিত্যযাত্রীদের। ঘুরপথে গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লেগে যাচ্ছে অনেকটা। দীর্ঘ দিন ধরে এ ভাবে নাকাল হতে হতে ক্ষোভ বাড়ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। পুলিশ নীরব ছিল।

২৭ জানুয়ারি, ২০২০: দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বিতর্কিত মন্তব্য কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুরের। শাহিন বাগের আন্দোলনকারীদের দেশদ্রোহী হিসাবে দাগিয়ে ‘দেশ কে গদ্দারো কো, গোলি মারো সালো কো’ স্লোগান তোলেন তিনি।

বিকাশপুরীর জনসভায় মুসলিমবিরোধী মন্তব্য করেন বিজেপি সাংসদ প্রবেশ বর্মা। শাহিন বাগের আন্দোলনকারীরা এ বার ঘরে ঢুকে মা-বোনেদের ধর্ষণ করবে বলে সমর্থকদের উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি।

২৮ জানুয়ারি, ২০২০: অনুরাগ ঠাকুর এবং প্রবেশ বর্মাকে শোকজ নোটিস ধরায় নির্বাচন কমিশন। তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে হবে বলে দাবি জানান বিরোধীরা। কিন্তু পুলিশের তরফে তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।

৩০ জানুয়ারি, ২০২০: দিল্লির জামিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সিএএ বিরোধী আন্দোলনরত পড়ুয়াদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় এক কিশোর। তাতে গুলিবিদ্ধ হন জামিয়ার এক কাশ্মীরি শিক্ষার্থী। ঘটনার সময় আততায়ীর পিছনেই হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিল পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়ার বদলে গুলি চালাতে চালাতে পুলিশের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল সে।

ফেব্রুয়ারি, ২০২০: শাহিন বাগের ধর্নায় ঢুকে ‘জয় শ্রী রাম’স্লোগান দিতে দিতে শূন্যে গুলি ছোড়েন কপিল গুর্জর নামের এক যুবক। তার পরেও শাহিন বাগ খালি করতে উদ্যোগী হয়নি দিল্লি পুলিশ।

২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০: পুলিশের অনুমতি না মেলা সত্ত্বেও ভজনপুরার চাঁদ বাগ থেকে সিএএ বিরোধী মিছিল করে চন্দ্রশেখর আজাদের ভীম আর্মির। মিছিল আটকাতে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি পুলিশ।

গত এক মাস ধরে জাফরাবাদের রাস্তার পাশে ধর্নায় বসে থাকা প্রতিবাদীরা ওই দিনই মূল রাস্তার উপর নেমে আসেন। রাস্তা আটকে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন তারা। তার জেরে যানজট তৈরি হতে দেখেও রাস্তা খালি করতে কোনও পদক্ষেপ করেনি পুলিশ। উল্টে সিগনেচার সেতু বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাতে ফের দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। রাস্তা খোলার দাবিতে সেতুর উপর ধর্নায় বসেন তাঁরা। তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয় পুলিশ। বাধা দিতে এলে বেশ কয়েক জনকে আটকও করা হয়। তাতেই পরিস্থিতি আরও তেতে ওঠে। বিক্ষোভকারীদের না হটিয়ে পুলিশ কেন সাধারণ মানুষকে শান্ত হতে বলছে, তা নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন অনেকে।

ওই দিন বিকেলে মৌজপুর পৌঁছন বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র। উত্তর-পূর্ব দিল্লির ডিসিপি বেদপ্রকাশ সূর্যকে পাশে রেখে তিনি হুমকি দেন, তিন দিনের মধ্যে জাফরাবাদ এবং চাঁদ বাগ থেকে বিক্ষোভ না উঠলে কারও কথা শুনবেন না, রাস্তা খালি করতে তারাই রাস্তায় নামবেন।

এর পরেই পরিস্থিতি আরও তেতে ওঠে। মৌজপুরে ধীরে ধীরে ভিড় জমতে থাকে সিএএ সমর্থকদের। জাফরাবাদ থেকে মৌজপুর বেরনোর দেড় কিলোমিটার রাস্তা বন্ধ করে দেন তাঁরা। আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে জাতীয়তাবাদী স্লোগান তুলতে শুরু করেন। এই পরিস্থিতিতে কবীর নগর, কর্দমপুরীতে দুই পক্ষের মধ্যে ইটবৃষ্টি শুরু হয়। তার কিছু ক্ষণের মধ্যে মৌজপুর থেকে ইট ছোড়া শুরু হয় জাফরাবাদের দিকে।

সন্ধে গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায় দু’পক্ষের মধ্যে। মৌজপুরে দু’টি গাড়িতে গাড়িতে আগুন ধরানো হয়। এলোপাথাড়ি ইটবৃষ্টির মধ্যে হাতাহাতিও বেধে যায় দু’পক্ষের মধ্যে। সব দেখেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি পুলিশকে।

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০: এ দিন সকাল থেকেই তেতে ওঠে মৌজপুর। ইটবৃষ্টি অব্যাহত, সেই সঙ্গে গুলিও চলতে শুরু করে। পুলিশের সামনেই ভিড়কে লক্ষ্য করে আট রাউন্ড গুলি চালায় শাহরুখ নামের এক যুবক। গুলি চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চম্পট দেয় সে। সংবাদমাধ্যমে ওই যুবকের ছবি ছড়িয়ে পড়তে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে মৌজপুরে পাথর ছোড়াছুড়ি বন্ধ হয়নি।

শুধু মৌজপুরই নয়, ভজনপুরা, চাঁদ বাগ, করাবল নগর, মুস্তফাবাদ এবং গোকুলপুরীতেও দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। পর পর বেশ কয়েকটি দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লুঠপাটও চলে দেদার। বেশ কিছু বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুন লাগানো হয় একটি পেট্রল পাম্পে। গোকুলপুরীতে একটি টায়ার কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে ধারে কাছে পুলিশকে দেখা যায়নি।

দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালীন ২৪ ফেব্রুয়ারি ভজনপুরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় পুলিশের হেড কনস্টেবল রতন লালের। পায়ে গুলি লেগে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জেরে মৃত্যু হয় মহম্মদ ফুরকান নামের এক ব্যক্তির। ওই দিন ভজনপুরায় সব মিলিয়ে ৫০ জন জখম হন। দোকানে দোকানে লুঠপাট চালানো হয়, পাথর ছোড়া হয় একাধিক বাড়িতে। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কে বাড়ি ছাড়তে শুরু করেন অনেকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিয়োয় পুলিশের উপস্থিতিতে পাথর জড়ো করতেও দেখা যায় এক দল যুবককে।

এত কিছুর পরেই হিংসা রুখতে কোনও পদক্ষেপ করেনি পুলিশ। সংঘর্ষে ঘায়েল হওয়ার আতঙ্কে বেশ কিছু জায়গা থেকে অভিযোগ পেয়েও আগুন নেভাতে যায়নি দমকল বাহিনী। হিংসাত্মক ঘটনা রুখতে উত্তর-পূর্ব দিল্লির একাধিক এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা এড়িয়েই জাফরাবাদ, মৌজপুর, ভজনপুরা, ব্রহ্মপুরী, করাবল নগরে দলে দলে লাঠি হাতে রাস্তায় নেমে আসেন সংঘর্ষকারীরা।

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০: সকাল থেকে বিক্ষোভের আগুনে তেতে ওঠে খাজুরি খাস, যমুনা বিহার এবং ব্রিজপুর এলাকা। দমকলের গাড়ি লক্ষ্য করেও পাথর ছোড়া হয়, তাতে ৩ জন দমকলকর্মী জখম হন। সব মিলিয়ে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত মৃত্যু সংখ্যা গিয়ে ঠেকে ১৩-য়। আহত হন কমপক্ষে ১৫০ জন।

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০: এ দিন মধ্য রাতে দিল্লির মু্খ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখান জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার পড়ুয়ারা। হিংসা রুখতে অবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রীকে পদক্ষেপ নেয়ারও দাবি জানান তারা। জলকামান দেগে বুধবার ভোর সাড়ে ৩টে নাগাদ সরিয়ে দেয় পুলিশ।

সৌজনৌ আনন্দবাজার

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত