ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

ধণাঢ্য যোগগুরু ও ইন্দিরা: ছিল সম্পর্কের গুঞ্জন

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২২, ১৮:৩০  
আপডেট :
 ১৩ জুন ২০২২, ১৮:৩৭

ধণাঢ্য যোগগুরু ও ইন্দিরা: ছিল সম্পর্কের গুঞ্জন
যোগগুরু ধীরেন্দ্র ও ইন্দিরা গান্ধী। ছবি: আনন্দবাজার অনলাইন

না, এই যোগগুরু কোনও আয়ুর্বেদিক পণ্যের ব্র্যান্ড খোলেননি। রাজনীতিতেও আসেননি। মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে যোগব্যায়াম শেখানোর জন্য তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। শোনা যায়, সে কাজ করতে দিল্লি আসার বছর কয়েক পর দিল্লি তো বটেই পুরো ভারতেরই রাশ নিজের আঙুলের ডগায় রেখেছিলেন যোগগুরু ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী। তবে সবার অলক্ষ্যে।

ধীরেন্দ্র ছিলেন এক দীর্ঘদেহী বিহারি সুপুরুষ। শোনা যায় তিনিই ছিলেন একমাত্র পুরুষ, যাকে একা ঘরে ইন্দিরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। প্রতিদিন সকালে তার সঙ্গে অন্তত একঘণ্টা চলত ইন্দিরার যোগাভ্যাস।

১৯৬০ সাল। তখন সদ্য বিধবা হয়েছেন ইন্দিরা। ফিরোজ গান্ধী মারা গেছেন। দুই পুত্র রাজীব এবং সঞ্জয় সবে কৈশোরে। ইন্দিরার বয়স ৪৩। ধীরেন্দ্রর সঙ্গে ইন্দিরার সাক্ষাৎ ওই বছরেই। যোগগুরুকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলেন নেহরু-কন্যা। যুক্তরাষ্ট্রের নামজাদা ফটোগ্রাফার ডরোথি নরম্যানকে লেখা সেই চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে এক সুপুরুষ যোগীর কাছে আমার যোগশিক্ষা শুরু হল।’ কেমন দেখতে ছিলেন সেই যোগী? ইন্দিরা বন্ধুকে লিখেছেন, ‘চমৎকার দেখতে। শারীরিক গঠনও বেশ আকর্ষক। যারা দেখেছেন প্রত্যেকেরই চোখ টেনেছে ওর উপর।’

ইন্দিরা নিজের কথা বলেননি। তবে তার সঙ্গে যোগগুরুর সম্পর্ক নিয়ে গল্প থেমে থাকেনি। ইন্দিরার জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন মার্কিন লেখিকা ক্যাথরিন ফ্র্যাঙ্ক। নিজের বইয়ে ক্যাথরিন লিখেছিলেন, বন্ধ দরজার ভেতর প্রতিদিন যোগীর সঙ্গে অনেকখানি সময় কাটাতেন ইন্দিরা। সে সময় যদি কারও সঙ্গে ইন্দিরার সম্পর্ক হয়ে থাকে, তবে তিনি এই যোগগুরুই।

গান্ধী এবং নেহরু পরিবারের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক ও লেখক ছিলেন খুশবন্ত সিং। সেই খুশবন্তও তার চিরপরিচিত রাখ-ঢাকহীন ঢঙে বলেছিলেন, ‘ধীরেন্দ্র একজন লম্বা-চওড়া সুঠাম শরীরের বিহারি। বন্ধ ঘরে রোজ সকালে ইন্দিরার সঙ্গে তার এক ঘণ্টার যোগশিক্ষা কামসূত্রের শিক্ষায় পরিণত হতেই পারে।’

মোট কথা ইন্দিরার সঙ্গে যে ধীরেন্দ্রর একটা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আলোচিত হতে শোনা গেছে। ইন্দিরা তখনও কোনও প্রশাসনিক পদে বসেননি। জওহরলালই দেশের প্রধানমন্ত্রী। এ কথা মনে হতেই পারে, বিরোধীরা নেহরু এবং তার পরিবারকে কলঙ্কিত করার জন্য এ ধরনের গুজব ছড়িয়েছিলেন। কিন্তু ইন্দিরা এবং যোগগুরুর সম্পর্ক নিয়ে তার শত্রুরা নন, বন্ধুরাই আলোচনা শুরু করেছিলেন সবার আগে। সেই আলোচনা জল পেয়ে তরতরিয়ে বেড়েছিল যোগগুরুর প্রতিপত্তি ক্রমে বেড়ে চলায়।

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কন্যার যোগ প্রশিক্ষক। ভারতে যোগগুরুর খ্যাতি ছড়াচ্ছিল দ্রুত। তার কাছ থেকে যোগ প্রশিক্ষণ পেতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক আশ্রমও তৈরি হচ্ছিল। যোগগুরু ধীরেন্দ্র সেসব আশ্রমে যাতায়াত করতেন নিয়মিত। আর যেতেন ব্যক্তিগত বিমানে চেপে।

ব্যক্তিগত সংগ্রহে দু’টি বিমান ছিল ধীরেন্দ্রর। তার মধ্যে একটি সে কালের ভারতে কেনা কিংবা চড়া তো দূর চোখেই দেখেননি কেউ। তার সঙ্গে ধীরেন্দ্রর ছিল বিদেশি গাড়ির শখ। সংগ্রহও ছিল দেখার মতো। সাধারণ ভারতীয় তো দূর অস্ত্, টাটা-বিড়লাদের মতো শিল্পপতিকেও সেই সব গাড়ি কিনতে ভাবতে হত দু’বার।

না, যোগগুরু কোনও আয়ুর্বেদিক পণ্যের ব্র্যান্ড খোলেননি ঠিকই। তবে প্রতিপত্তির চূড়ায় পৌঁছে ধীরেন্দ্র একটি এয়ারলাইন্স সংস্থা খুলে ফেলেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন ‘এয়ার অপর্ণা’। তার বিমান পরিবহণ সংস্থা এয়ার ট্যাক্সি পরিষেবা দিত। বিমান ওঠানামা করার জন্য ব্যক্তিগত তিনটি রানওয়ে ছিল ধীরেন্দ্রের। ছিল বিমান রাখার তিনটি নিজস্ব হ্যাঙ্গারও।

ইন্দিরার যোগশিক্ষকের প্রতিপত্তি যখন শিখর ছুঁয়েছে, তখন যোগাসন, বিমান, বিদেশি গাড়ির বাইরে যোগগুরু ধীরেন্দ্রের আগ্রহ ছিল বন্দুকেও! জম্মুতে বন্দুক তৈরির একটি কারখানা খুলেছিলেন ধীরেন্দ্র। নাম ‘শিবা গান ফ্যাক্টরি’। অনুমতি বা জমি কোনওটাই পেতে বিশেষ কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। এমনকি, যোগগুরুর বিরুদ্ধে যখন ওই কারখানার জন্য ৫০০ স্প্যানিশ গান ব্যারেল চোরা পথে দেশে আনার অভিযোগ ওঠে, তখন আগাম জামিন পেতেও কোনও অসুবিধা হয়নি তার।

এর উপর যোগগুরুকে তার যোগশিক্ষার জন্য দূরদর্শনের প্রাইম টাইমের সময় দেয়া হয়েছিল। টিভিতে নিয়মিত হত তার অনুষ্ঠান। তা-ও আবার চিত্রহারের মতো জনপ্রিয় অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক আগেই। ভুলে গেলে চলবে না, ১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লালবাহাদুর শাস্ত্রী দায়িত্ব নিলেন, তখন দেশের কেন্দ্রীয় তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রী পদে দায়িত্ব নেন ইন্দিরা। দুই বছর তিনি ওই পদে ছিলেন।

১৯৮০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দিরা। একই বছরে সঞ্জয় গান্ধীও সংসদ সদস্য হন। শোনা যায় এই সময় যোগগুরুর প্রতিপত্তি ছিল সবচেয়ে বেশি। সঞ্জয়ের যে সব নীতি চূড়ান্ত সমালোচিত হয়েছিল, সেই সব নীতিকে প্রকাশ্যেই সমর্থন করতে শোনা যায় ধীরেন্দ্রকে। সঞ্জয়ও পছন্দ করতেন ধীরেন্দ্রকে। যোগগুরুর ব্যক্তিগত বিমান চালিয়ে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতেন সঞ্জয়।

শোনা যায়, এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তার পদ খোয়াতে বসেছিলেন ধীরেন্দ্রর জন্য। যোগগুরু তার আশ্রমের জন্য জমি চাইলে সেই অনুরোধ খারিজ করে দিয়েছিলেন ইন্দিরার মন্ত্রিসভার আবাসন প্রতিমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরাল। আইন দেখিয়ে গুজরাল যোগগুরুকে বলেছিলেন, তাকে জমি দেয়া হলে তা হবে বেআইনি কাজ। জবাবে যোগগুরু নাকি তাকে বলেছিলেন, ‘যদি জমি না দাও, তবে কালই মন্ত্রিত্ব খোয়াতে হবে তোমাকে।’ অদ্ভুতভাবে এ ঘটনার পরই ইন্দিরার মন্ত্রী গুজরালের দায়িত্ব বদলে দেয়া হয়। এরপর ইন্দিরা বিরোধীদের অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন মসনদে ইন্দিরা থাকলেও আসলে কেন্দ্রের ক্ষমতার রাশ জড়ানো আছে যোগগুরু ধীরেন্দ্রর হাতে।

তবে জল্পনা এর বেশি বাড়তে পারেনি। ১৯৮৪ সালে মৃত্যু হয় ইন্দিরার। তার ১০ বছর পর ১৯৯৪ সালে নিজের বিমানে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় মারা যান ধীরেন্দ্রও। বিহারের এ যোগগুরুর আখ্যান তদবধি রহস্য হয়েই থেকে গেছে। সূত্র: আনন্দবাজার অনলাইন।

বাংলাদেশ জার্নাল/টিটি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত