ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

ভারতীয় এমপির যে ভাষণে উত্তাল স্যোশাল মিডিয়া

ভারতীয় এমপির যে ভাষণে উত্তাল স্যোশাল মিডিয়া
পার্লামেন্টে বক্তব্য রাখছেন এমপি মহুয়া মৈত্র

ভারতীয় লোকসভায় প্রথমবারের মত এমপি হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস দলের মহুয়া মৈত্র। মঙ্গলবার পার্লামেন্টে প্রথম ভাষণে তিনি ফ্যাসিবাদ বা কর্তৃত্ববাদী জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক লক্ষণসমূহ নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল বিজেপির স্বেচ্ছাচারী রাজনীতির বিরুদ্ধে দেয়া তার এ বক্তব্য ভারতের সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুলেছে। অনেকে মহুয়ার এই বক্তব্যকে ‘বছরের সেরা’ভাষণ হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন।

তৃণমূল এমপি মহুয়া মৈত্র বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে একটি পোষ্টারে তিনি ফ্যাসিবাদের প্রাথমিক লক্ষণসমূহের এক তালিকা দেখেছিলেন। তালিকার সেসব লক্ষণ তিনি একে একে পড়ে শুনিয়ে বলছিলেন, ভারতের সংবিধান এখন হুমকির মুখে এবং দেশটির ক্ষমতাসীন দলের 'বিভক্তির রাজনীতি'র কারণে ভারত এখন 'ছিড়ে টুকরো' হয়ে যাচ্ছে।

মহুয়া মৈত্র শুরুতেই ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নির্বাচনে ব্যাপক বিজয়ের উল্লেখ করে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। গত সাত মাস ধরে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হয় মে মাসের শেষ দিকে। এই ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতেভারতের দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেছে নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি।

মহুয়া মৈত্র বলেন, এই বিপুল বিজয়ের একটি প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়েছে ভিন্নমতাবলম্বনকারীদের কণ্ঠস্বর যাতে ‘অশ্রুত' থাকে তা নিশ্চিত করা।

ফ্যাসিবাদের সাতটি প্রাথমিক লক্ষণ

মঙ্গলবার মহুয়া যখন প্রথমবারের মত পার্লমেন্টে বক্তব্য রাখতে উঠে দাঁড়ান তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা ‘ধুয়ো’ধ্বনি দিতে শুরু করেন। তার মধ্যেই তিনি ফ্যাসিবাদের সাতটি প্রাথমিক লক্ষণ পড়ে শোনান। সেগুলো হলো নিম্নরূপ:

১. দেশে শক্তিশালী ও ধারাবাহিক জাতীয়তাবাদ ক্রমে দেশের জাতীয় পরিচয়ে পরিণত হয়। এটা 'সুপারফিশিয়াল' বা এর আসলে কোন গভীরতা নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। এটা বর্ণবাদ এবং সংকীর্ণ ভাবনা। এটা বিভক্তি বাড়ায় আর কোনভাবেই ঐক্যের চেষ্টা করে না।

২. ‘মানবাধিকারের প্রতি একটি ব্যাপক অবজ্ঞা’দেখা যাচ্ছে, যা ২০১৪ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে অন্তত ১০গুন বেড়েছে ।

৩. গণমাধ্যমের ওপর কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণের কড়া সমালোচনা করেন মহুয়া বলেন, ভারতের টিভি চ্যানেলগুলো নিজেদের এয়ারটাইমের বড় অংশ ক্ষমতাসীন দলের প্রচার-প্রোপাগান্ডায় ব্যয় করছে।

৪. জাতীয় নিরাপত্তায় বাড়তি সচেতনতার জন্য সরকারকে আক্রমণ করে তিনি বলেন, ভারতে এক ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শত্রু তৈরি করা হচ্ছে।

৫. ‘সরকার ও ধর্ম পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। এ সম্পর্কে কি আমার বলবার প্রয়োজন আছে? আমার কি বলার প্রয়োজন আছে যে নাগরিক হবার মানে কী সেটাই আমরা বদলে দিয়েছি?’ তিনি উল্লেখ করেন মুসলমানদের টার্গেট করে আইনে সংশোধন আনা হয়েছে।

৬. বুদ্ধিজীবী ও শিল্পের প্রতি চরম অবজ্ঞা দেখানো হয়েছে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর শোষণ চালানো হয়েছে। একে ফ্যাসিবাদের সব চিহ্নের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করে মহুয়া মৈত্র বলেন, ‘এটা ভারতকে অন্ধকার যুগে নিয়ে গেছে।’

৭. দেশটির নির্বাচন ব্যবস্থার স্বাধীনতা নষ্ট হয়ে গেছে এবং একে তিনি ফ্যাসিবাদের শেষ চিহ্ন হিসেবে উল্লেখ করেন।

কে এই মহুয়া মৈত্র

জেপি মর্গানের সাবেক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার মহুয়া মৈত্র রাজনীতিতে যোগ দেয়ার জন্য ২০০৯ সালে লন্ডনে নিজের চাকরিতে ইস্তফা দেন। কয়েক বছর ধরে তিনি তৃনমূল কংগ্রেসের জাতীয় মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছিলেন এবং নিয়মিত টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নিতেন।

সর্বশেষ নির্বাচনের সময় পশ্চিম বাংলায় কৃষ্ণনগরের প্রত্যন্ত গ্রামে প্রচারণা চালান তিনি। সেখানে সবসময় ধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন তিনি। কেবল তাই নয়, তিনি কাশ্মীরে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলা এবং পাকিস্তানে চালানো ভারতের বিমান হামলার সমালোচনা করেন। এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে বিজেপি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি তৈরির চেষ্টা চালায় বলেও তিনি দলটির সমালোচনা করেন।

মঙ্গলবার পার্লামেন্ট দশ মিনিট বক্তব্য রাখেন মহুয়া মৈত্র। পুরো সময়টা ট্রেজারি বেঞ্চ বা সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা হট্টগোল করে তাকে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে তাকে একবারো বিচলিত হতে দেখা যায়নি। বরং তিনি দৃঢ়ভাবে দাড়িয়ে নিজের বক্তব্য শেষ করেন।

এ সময় তিনি বেশ কয়েকবার স্পিকারকে তার 'পেশাগত দায়িত্ব' পালনের আহ্বান জানান।

মহুয়া মৈত্রের বক্তব্য কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

মহুয়া মৈত্র নানা তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করে ১০ মিনিট ধরে ইংরেজিতে বক্তব্য রাখেন। মাঝখানে কেবল হিন্দিতে কয়েক ছত্র কবিতার উদ্ধৃতি দেন। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই এ হিন্দি কবিতা আওড়ানোর জন্য তার ব্যাপক প্রশংসা করেন। কারণ তিনি হিন্দিভাষী নন, তার মাতৃভাষা বাংলা।

ফলে মঙ্গলবার তিনি যখন প্রথমবারের মত ভাষণ দিতে দাঁড়ান, অনেকেই একটি বুদ্ধিদীপ্ত বক্তৃতাই আশা করেছিল। কিন্তু অনেকের কাছেই এটা ছিল ‘বুদ্ধিদীপ্ত’র চেয়ে বেশি কিছু। কিছুক্ষণের মধ্যেই টুইটারে এ নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। তার এই ভাষণকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

কারণ দেশটির পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং পার্লামেন্টে বিরোধী দল কোনঠাসা। আরো গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে ভারতের রাজনীতি এখনো অনেক বেশি পিতৃতান্ত্রিক। ভারতের রাজনীতিতে এখনো নারীর সংখ্যা কম, বিশেষ করে হাউজে নারীর সংখ্যা মাত্র ১৪ শতাংশ।

এর মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক নারীই জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন, বাকিরা নীরবই থাকেন। মহুয়া মৈত্রের এই শক্তিশালী ভাষণ অন্য নারী এমপিদের উৎসাহিত করবে বলেও মনে করছেন অনেকে।

ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রমে দুর্বল করে দেবার অভিযোগ তোলা হচ্ছে বিজেপির বিরুদ্ধে। তবে সে অভিযোগ সব সময়ই অস্বীকার করে এসেছে বিজেপি।

কিন্তু কেবল রাজনৈতিক দলই নয়, বিভিন্ন মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনও বিজেপির বিরুদ্ধে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের নামে ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষতাকে ধূলিসাৎ করা হচ্ছে এমন অভিযোগ করে আসছে।

বুধবার বিবিসি হিন্দিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মহুয়া মৈত্রী বলেন, ‘পার্লামেন্টে আমরা যেহেতু বিরোধী দল, আমাদের বেশি বেশি নানা ইস্যুতে কথা বলতে হবে। সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে, ঘাটতিগুলো দেখিয়ে দিতে হবে। এটাই আমার দায়িত্ব এবং আমার সবোর্চ্চ সামর্থ্য দিয়ে আমি তা করে যাব।’

নির্বাচনী প্রচারণায় মহুয়া মৈত্র

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত