ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

ব্রিটেনকে কোন অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে ব্রেক্সিট?

ব্রিটেনকে কোন অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে ব্রেক্সিট?

ব্রেক্সিট ইস্যুকে কেন্দ্র করে গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত ব্রিটেন। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে বুধবার রাতে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে দুই দফা পরাজিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। দেশে আগাম নির্বাচন নিয়ে হাউজ অব কমন্সে প্রধানমন্ত্রীর আনীত প্রস্তাবটিও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় বাতিল হয়ে গেছে।

এর আগে মঙ্গলবার রাতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট সংক্রান্ত এক প্রস্তাবে আরো একবার পরাজিত হন তিনি। যার জের ধরে পরদিন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের ২১ বিদ্রোহ এমপিকে বরখাস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এ অবস্থায় কঠিন সঙ্কটের মুখে পড়েছে যুক্তরাজ্যের রাজনীতি। এখন প্রশ্ন এরপর কী হতে যাচ্ছে দেশটিতে এবং কী ঘটতে পারে আগামী দিনগুলোতে?

ভোটাভুটিতে কেন হারলেন বরিস?

ব্রেক্সিট ইস্যুতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে পরাজিত হন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। বিরোধী দলের পাশাপাশি নিজ দলের বিদ্রোহী এমপিরাও তার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন। সবমিলিয়ে তার নিজ দলের ২১ জন এমপি বিরোধীদের সাথে মিলে তার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন। ফলে হাউজ অফ কমন্সে ৩২৮-৩০১ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান প্রধানমন্ত্রী জনসন। ভোটাভুটিতে হেরে যাওয়ার পর নিজ দলের ২১ বিদ্রোহী প্রার্থীকে বরখাস্ত করেন বরিস। এই ভোটে জেতার ফলে এমপিরা কমন্স সভার কার্যসূচির নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছেন চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট ঠেকানোর জন্য তারা বুধবার একটি বিলও পাশ করেছেন।

বুধবার ব্রিটিশ এমপিরা 'নো-ডিল ব্রেক্সিট' বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে চুক্তি ছাড়া বেরিয়ে যাবার বিষয়টি আটকে দিয়ে একটি বিল পাশ করেছেন সংসদে। এই বিলটি এনেছিলো ব্রিটেনের বিরোধী দলগুলো। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির একদল বিদ্রোহী এমপি, যাদেরকে বুধবার বরখাস্ত করেছিলেন বরিস। এই বিলে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে একটি সমঝোতা করে পার্লামেন্টে নিয়ে আসতে না পারেন, তাহলে তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে ফিরে যেতে হবে এবং অনুরোধ জানাতে হবে ব্রেক্সিটের সময়সীমা যেন আগামী ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়।

এই অনুরোধ জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইউরোপীয় ইউনিয়নে যে চিঠি পাঠাবেন, সেটার ভাষা কী হবে বিলে সেটিও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

বুধবার পার্লামেন্টে এই বিল পাশ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আগামী ১৫ই অক্টোবর দেশে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তাব আনেন। কিন্তু তার সেই প্রস্তাবটিও বাতিল হয়ে যায়। এটি পাস করার জন্য পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ এমপির সমর্থনের প্রয়োজন ছিলো, যা জোগাড়ে তিনি ব্যর্থ হন।

যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য নির্ধারিত তারিখ এখন ৩১শে অক্টোবর। কিন্তু বাণিজ্য, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং অভিবাসনের মত বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাজ্য এবং ইইউ-র মধ্যে ভবিষ্যত সম্পর্ক কী হবে সেটা নিয়ে কোন চুক্তি হয়নি। বহু মানুষ এই কারণে উদ্বিগ্ন যে নতুন একটি চুক্তি সম্পাদনের জন্য হাতে একেবারেই সময় নেই।

সরকারের হেরে যাবার অর্থ হল এই চুক্তি-বিহীন ব্রেক্সিট ঠেকাতে সংসদে বিতর্ক হবে। অনেক এমপিই আশংকা করেন চুক্তি-বিহীন ব্রেক্সিট হলে তা ব্রিটিশ অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং যুক্তরাজ্যে খাদ্য ও ওষুধের সরবরাহ ব্যাহত হবে।

আর এই বিলের অর্থ হবে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুক্তরাজ্য যদি ইইউ-র সঙ্গে একটা ব্রেক্সিট চুক্তিতে সম্মত না হতে পারে, তাহলে ইউকে-র ব্রিটেন থেকে বেরিয়ে যাবার তারিখ ২০২০ সালের ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত পেছানো হবে।

এদিকে চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট ঠেকানোর এমপিদের এই উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি পার্লামেন্টে পাশকৃত বিলটিকে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে আত্নসমর্পন’হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি এখন চাইলেই তার ইচ্ছামত সাধারণ নির্বাচন ডাকতে পারছেন না। এর আগে মঙ্গলবার পার্লামেন্ট ভোটাভুটির পরপরই এই বিল পাশ হলে সাধারণ নির্বাচন ডাকবেন বলে জানিয়েছিলেন বরিস জনসন।

তিনি তখন আরো বলেন, সমালোচকরা চুক্তি-বিহীন ব্রেক্সিটের ক্ষতিকর প্রভাবটা অনেক বাড়িয়ে দেখাচ্ছেন এবং তিনি দাবি করেছেন একটা ব্যবস্থা নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছনর সময় ও সুযোগ এখনও আছে।

সাধারণ নির্বাচন কি হচ্ছে?

আপাতত সেই সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে না। বুধবার প্রধানমন্ত্রী বরিসের আনা এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেছে। এরপর তিনি কি পদক্ষেপ নেন সেটাই দেখার বিষয়।

কারণ নির্বাচন ডাকার মতো পার্লামেন্টে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেই। তবে বিরোধী দল লেবার পার্টির সমর্থন পেলে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব। আর লেবার দলের এমপিদের সমর্থন ছাড়া নির্বাচন ডাকার পক্ষে যথেষ্ট ভোট পাওয়া সম্ভব হবে না।

সরকার সংসদ স্থগিত করে দেবার সিদ্ধান্ত

গত সপ্তাহে সরকার বলেছিল সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসে প্রায় পাঁচ সপ্তাহের জন্য সরকার সংসদ বন্ধ করে দেবে। শীর্ষ বিরোধী এমপিরা এই সিদ্ধান্তকে একটা ‘অভ্যুত্থান’বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জোর দিয়ে বলেছিলেন তিনি শুধু নতুন কিছু আইন উত্থাপনের জন্য এই সংসদ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেন।

সমালোচকরা দাবি করেছেন সরকার সংসদের কার্যদিবস সীমিত রাখার জন্যই এই পদক্ষেপ নিয়েছে যাতে চুক্তি-বিহীন ব্রেক্সিট ঠেকাতে সংসদে ভোটদানের সুযোগ না পাওয়া যায়। সেটাই যদি সরকারের পরিকল্পনা হয়ে থাকে, তাহলে তা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ এমপিরা এখন বরিসের ৩১ অক্টোবর চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিটের পরিকল্পনা আটকে দিয়েছে।

যদিও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংসদ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তের সঙ্গে ব্রেক্সিটের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু সংসদের অধিবেশনের উদ্বোধন করে রানি যে ভাষণ দেন তার জন্য এটা প্রয়োজন। এই ভাষণে সংসদে আগামী বছরে সরকার যেসব নতুন আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা করছে রানি সেগুলো পাঠ করে শোনান।

কি হবে ব্রেক্সিটের?

যুক্তরাজ্যে চুক্তি ছাড়া ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা হয়ত কমেছে, কিন্তু এর ফলে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা হয়ত বেড়ে গেছে।

বিবিসির রাজনৈতিক সম্পাদক লরা কুয়্যন্সবার্গ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ মনে করেন এই সঙ্কট একটা সমস্যা সমাধানের সুযোগ করে দিতে পারে। সেটা হল ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট গণভোটের ফলাফল বাস্তবায়নের যে কাজটা এখনও অসমাপ্ত রয়ে গেছে সেটা শেষ করা। টোরি পার্টি এখন দেখাবে ব্রেক্সিট নিয়ে এ পর্যন্ত সবচেয়ে স্পষ্ট বার্তা তারাই বহন করছে।’

এই সঙ্কটের কারণে ব্রিটেনে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে বরিস জনসন এবং তার কনজারভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে। এরপর তাদের পক্ষে কোনো চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হয় তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু জেরেমি করিবনের লেবার পার্টি যদি নির্বাচনে জেতে, ব্রিটেন তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হাঁটবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

এছাড়া নির্বাচনে কোনো দল বা কোনো জোটই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলো না, এমন সম্ভবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। আর তেমনটা হলে ব্রেক্সিট প্রশ্নে যুক্তরাজ্যে সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে এবং দেশটির রাজনীতি আরও বেশি বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত