ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

করোনা থেকে মুক্তি

  সারিকা দেব

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২০, ২০:৩৪  
আপডেট :
 ২৯ এপ্রিল ২০২০, ২০:৩৫

করোনা থেকে মুক্তি

মাত্র পাঁচ মাস আগের কথা, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখে চীনের হুবাই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনা ভাইরাস রোগী সনাক্ত হয়। তখন কী কেউ ঘুণাক্ষরে ও মনে করেছিলো যে এই ভাইরাস সারা পৃথিবীতে এভাবে ছড়িয়ে পড়বে আর এত এত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিবে? সারা পৃথিবীর অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিবে, মানুষের স্বাভাবিক জীবন সম্পূর্ণ ভাবে বিপর্যস্ত করে দিবে?

মাত্র কয়েকটা মাসের মধ্যে সারা পৃথিবীকে উলোট-পালোট করে দিয়েছে এই ভাইরাস। সারা বিশ্বের সব গবেষক আর সায়েন্টিস্টরা দিবা-রাত্রি লড়ে চলেছেন এই ভাইরাস কে পরাস্ত করার জন্য। মানবজাতিকে এই ভয়াবহ ভাইরাসের কবল থেকে রক্ষা করতে অথবা আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে আর বিশ্ব অর্থনীতিকে সচল করতে তাদের অপরিসীম প্রয়াস নিয়েই আজ লিখব।

প্রথমে উল্লেখ করা যাক, ‘এন্টিবডি টেস্ট’ এর কথা। গবেষকরা ‘এন্টিবডি টেস্ট’ বা ‘সেরলজি টেস্ট’ নিয়ে অনেকদিন ধরে কাজ করছেন, যেটা হয়তো এই ভাইরাস কে পুরোপুরি পরাস্ত করতে পারবেনা, কিন্তু এই টেস্টের মাধ্যমে কমপক্ষে জানা যাবে এই ভাইরাস কোন ব্যক্তিকে অতীতে আক্রমণ করেছে কিনা এবং তার দেহ এই ভাইরাস প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অর্জন করেছে কিনা।

যদি এই টেস্টটা নির্ভুলভাবে প্রমাণিত করতে পারে যে কিছু মানুষ কে এই ভাইরাস আর এই সিজনে আক্রমণ করবে না, তবে তারা নিশ্চিত হয়ে কাজে ফিরে যেতে পারবে। এভাবে যদি ধীরে ধীরে একটা দেশের প্রতিটা মানুষকে এই টেস্টের আওতায় আনা যায়, তবে জনসাধারণের একটা বড় অংশকে কাজে ফিরিয়ে আনা যাবে, যেটা দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে সহযোগিতা করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে টেস্টটার নির্ভুলতা নিয়ে।

বিশ্ববাজার মোটামুটি ছেয়ে গেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত এন্টিবডি টেস্ট-কিটে। আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ফুড এন্ড ড্রাগ ইন্সটিটিউশন (এফডিএ) এই পর্যন্ত মাত্র ৪টা কোম্পানির এন্টিবডি টেস্ট কিটকে অনুমোদন করেছে। অর্থাৎ এই ৪টা কোম্পানির উৎপাদিত কীট দ্বারা টেস্ট করলে রেজাল্ট নির্ভুল আসার সম্ভাবনা বেশি। ফুড এন্ড ড্রাগ ইন্সটিটিউশন আরো কোম্পানির কিটকে অনুমোদন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে যদি প্রচুর পরিমাণ অনুমোদিত এন্টিবডি টেস্ট কিট বাজারে আসে আর সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য করে দেওয়া যায় তাহলে মানুষ নিশ্চিতভাবে কাজে ফিরে যেতে পারবে আর দেশের অর্থনীতিকে চালু করতে পারবে। আমরা সারা পৃথিবীর মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম এই এন্টিবডি টেস্টের ফলপ্রসূ ফলাফল নিয়ে। কিন্তু আমাদের আবারো আশাহত হতে হল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া গতকালের রিপোর্টে।

এই রিপোর্ট অনুযায়ী কোনো মানুষের এন্টিবডি টেস্ট পজিটিভ হলেই যে সে ভবিষ্যতে কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হবেনা, এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না, হয়তো এই সিজনে আর আক্রান্ত হবেনা। তবে অতীতের মেডিক্যাল গবেষণা আর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় কোন ব্যক্তি যদি একবার কোন শক্তিশালী গোত্রের ভাইরাসে আক্রান্ত হয় তবে ভবিষ্যতে সেই একই ব্যক্তির সেই একই ধরনের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক কম আর যদিও হোন তা তাকে তেমন ভাবে আক্রান্ত করতে পারেনা, যেহেতু তার দেহ এই ভাইরাস প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অর্জন করেছে।

কোরিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এর ভাষ্যমতে, যদি কভিড-১৯ ভাইরাস দ্বারা কেউ পুনরায় আক্রান্তও হোন, তার দ্বারা অন্য কারো আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা একেবারেই কম।আমেরিকার নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি সহ কয়েকটা প্রদেশে ইতিমধ্যে জনগণের মধ্যে এই টেস্ট দেওয়া শুরু হয়েছে এবং প্রদেশ গুলার গভর্নর নিশ্চিত করছেন যে সব ফার্স্ট রেসপন্ডার, ইমারজেন্সি ওয়ার্কার আর ডাক্তার-নার্সকে প্রথমে এই টেস্টের আওতায় আনতে, যাতে করে তারা অন্তত: নিশ্চিত হয়ে সাময়িক ভাবে তাদের কাজে ফিরে যেতে পারেন এবং রুগীদের সেবা করতে পারেন। ধীরে ধীরে সবার জন্য এই টেস্ট সহজলভ্য করে দেওয়া হবে। যখন মানসম্মত এন্টিবডি টেস্ট প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হবে এবং নির্ভুল ফলাফল দিতে থাকবে আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জনগণকে এই টেস্ট সুবিধা দিতে পারবে তখন আমরা এই ভাইরাসের কবল থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাব আর অর্থনীতির চাকাকে চালু করতে পারব।

দ্বিতীয়ত: বলা যায়, কভিড-১৯ এর মেডিসিনের কথা, যেটা নিয়েও অনেকদিন ধরে গবেষণা চলছে। তবে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এমন কোনো ওষুধ আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি যা দ্বারা এই প্রাণঘাতী রোগকে নির্মূল করা যায়। অনেক ধরণের কভিড-১৯ এর ওষুধের কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু চিকিৎসক, গবেষকরা সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন যেন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেউ ই এসব ওষুধ সেবন না করেন।

সাম্প্রতিক সময়ে হাইড্রোক্সোক্লরকুইন আর এন্টিবায়োটিক এজিত্রমাইসিন কে অনেকে এবং অনেক মাধ্যমে কভিড-১৯ এর প্রতিকারক ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলো এবং অনেকে এই ওষুধ গুলা কভিড-১৯ এর প্রতিকারক হিসেবে প্রয়োগ ও করেছিলো। কিন্তু এই ওষুধ গুলো ব্যবহার করে ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক প্রভাব ই বেশী দেখা গেছে। উপরন্তু কয়েকটা দেশে দেখা গেছে যারা হার্ট আর কিডনি রোগে আক্রান্ত তাদেরকে কভিড-১৯ এর প্রতিকারক হিসেবে এই ওষুধ দেবার কারণে তাদের সাংঘাতিক শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছিলো বা অনেকের এই কারণে মৃত্যুও হয়েছে।

অতি সম্প্রতি গিলিড কোম্পানির উৎপাদিত ‘রেমডেসিভির’ নামে একটা মেডিসিনের কথা শোনা যাচ্ছে, যেটা ‘এবলা’ প্রতিরোধে সাহায্য করেছিল। এই ওষুধটা নিয়ে গবেষকরা খুবই আশান্বিত। জাপানী গবেষকরা আশা করছেন গবেষনার আরো কয়েকটা পর্যায় সম্পন্ন করতে পারলেই এই ওষুধটা তারা বাজারে ছাড়তে পারবেন করোনার প্রতিষেধক হিসেবে।

তাছাড়া ‘কেভজারা’ নামে আরেকটা মেডিসিন নিয়েও গবেষণা খানিকটা এগিয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত কোনো ওষুধই ১০০% অনুমোদন পায়নি। আসলে কোনো একটা নতুন ভাইরাসের যথাযথ ওষুধ আবিষ্কার করতে অনেক অনেক দিন সময় লেগে যায়, তবুও গবেষকরা তাদের প্রাণান্ত চেষ্টা অব্যহত রেখেছেন এ আশায় যে কিছুদিন আগেও যদি তারা এই ভয়ংকর রোগের কোনো ওষুধ আবিষ্কার করতে পারেন, তবে কিছু মানুষের প্রাণ তো তারা বাঁচাতে পারবেন।

তবে আমরা সবাই এতদিনে বুঝে গেছি যে এই ভয়ংকর কভিড-১৯ এর চুড়ান্ত সমাধান হল ভেক্সিন। শুধুমাত্র ভেক্সিনের মাধুমেই এটাকে পুরোপুরি ভাবে নির্মূল করা যাবে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কোম্পানির প্রায় ৭৭ টা ভেক্সিন এখন পরিক্ষামুলক পর্যায়ে রয়েছে, তার মধ্যে ৬ টা ভেক্সিন প্রায় প্রথম পর্যায় অতিক্রম করেছে। গবেষক আর ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো নিশ্চিত হতে চায়, তাদের যে ভেক্সিনটা বাজারে আসবে সেটি শুধুমাত্র কার্যকরী ই হবেনা ১০০% নিরাপদ ও হবে। তারা এটাও নিশ্চিত করতে চায় যে ভেক্সিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সর্বনিম্ন পরিমাণ হবে। আর সবকিছু বজায় রেখে এই ভাইরাসের ভেক্সিনটা বাজারে আসতে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগবে।

তার মানে, যদি ভেক্সিন তৈরীর পদ্ধতি গত ডিসেম্বর মাসে শুরু হয় তবে ভেক্সিন এসে মানুষের হাতে পৌঁছতে কমপক্ষে এ বছরের নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাস হবে।

তবে, যেহেতু অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই ভেক্সিন তৈরীর কাজ অনেক আগে থেকে শুরু করেছে, সে অনুযায়ী অনেক গবেষনণা প্রতিষ্ঠানের ভেক্সিন আরো আগেও বাজারে আসতে পারে। এপ্রিল ২৭-এর তথ্য অনুযায়ী বৃটেনের অক্সফোর্ট গ্রোপ ঘোষণা করেছে তারা তাদের প্রস্তুতকৃত ভেক্সিন এর কিছু পরিমাণ এই সেপ্টেম্বরেই বাজারে ছাড়তে পারবে এবং তারা নিশ্চিত করেছে সেই ভেক্সিন কার্যকরও হবে আর নিরাপদ ও হবে।

ফুড এন্ড ড্রাগ ইন্সটিটিউশন (এফডিএ) এর দেওয়া নিচের ছকটার মাধ্যমে ভেক্সিন আবিষ্কারের পর্যায়গুলো সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে। এই করোনা ভাইরাসের কবলে পড়ে সারা পৃথিবী দুই-তিন মাস যাবত স্থবির হয়ে গেছে, লকডাউনে থাকার কারণে যেহেতু লোকজন বাইরে বের হতে পারছেনা, সেই কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, কৃষিকাজ, স্কুল-কলেজ সব বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় সারা পৃথিবী ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুক্ষীন হবে বলে বিজ্ঞজনেরা ধারণা করছেন আর বিভিন্ন দেশে এর আভাস ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে। এখনো মানুষ মারা যাচ্ছে, এখনও নতুন করে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। চুড়ান্ত সমাধান ভেক্সিন বাজারে আসার সময় যেহেত এখনও অনেক বাকি, তাই আমরা তাকিয়ে আছে এন্টিবডি টেস্টের একটা ফলপ্রসু ফলাফলের জন্য, আমরা অপেক্ষা করে আছি কোনো একটা নিরাপদ আর কার্যকরি কভিড-১৯ প্রতিষেধক ওষুধের জন্য।

গবেষক আর সায়েনটিস্টরা তাদের প্রাণান্ত চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন, হয়তো কিছুদিনের মধ্যে আমরা ভালো কোনো খবর পেতে পারি। এখন এই বিজ্ঞান আর গবেষণাই তো আমাদের একমাত্র ভরসা!

আমরা সারা বিশ্বের মানুষ আজ বিজ্ঞানের সেই অতি প্রতীক্ষিত আবিষ্কারের জন্য পিপাসু হয়ে আছি, যে আবিষ্কারের মাধ্যমে আমদের চির পরিচিত পৃথিবীকে আমরা আবার খুঁজে পাবো। নিশ্চিত করতে পারব নিজেদের অস্তিত্ব আর নিরাপদে রেখে যেতে পারব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে।

লেখক: সারিকা দেব, আমেরিকা প্রবাসী

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত