ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

দুঃসাহসী আক্রমণে দিশেহারা পাকহানাদার বাহিনী

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০৩:১৫

দুঃসাহসী আক্রমণে দিশেহারা পাকহানাদার বাহিনী
ছবি: সংগৃহীত

একাত্তরের ৫ ডিসেম্বর সীমান্ত এলাকাসহ পুরো বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রচন্ড লড়াই। মিত্রবাহিনীর যুদ্ধের তৃতীয় দিন। শক্তিশালী ভারতীয় বাহিনী ও দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকহানাদার বাহিনী। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আর কখনও পড়েনি তারা। দিনটি তাদের জন্য আসন্ন চরম বিপর্যয়ের বার্তাই বয়ে এনেছিল। ঢাকার আকাশ পুরোপুরি মিত্রবাহিনীর দখলে। পাকবাহিনীর সব জঙ্গি বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দখলমুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে আসতে থাকেন। সম্মুখসমরের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধেও হারতে থাকে পাকিস্তান।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত তথ্যভান্ডার থেকে প্রাপ্ত বর্ণনা মতে, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিমানবাহিনী এদিন চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। ফলে এদিনের পর ঢাকার আকাশে আর কোন জঙ্গি বিমান ওড়েনি। এর একদিন পরই ভারত সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজয়ের খবর আসছে।

একাত্তরের এই দিনেও বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন উত্তপ্ত ছিল। পাকিস্তানের কূটনৈতিক কূটকৌশলে মুক্তিযুদ্ধ থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা শুরু হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল লড়াইটা ছিল তৎকালীন দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আর যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পক্ষে।

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব শিবির দুইভাগে ভাগ হয়ে সংঘাতে জড়িয়ে যেতে পারে। আগের দিন (৪ ডিসেম্বর) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের নগ্নভাবে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করার প্রেক্ষাপটে এই দিন সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবটি ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক রাজনৈতিক নিষ্পত্তি প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘাতের অবসান ঘটবে।’ এই প্রস্তাবে পোল্যান্ড সমর্থন জানায়। কিন্তু চীন ভেটো প্রদান করে এবং নিরাপত্তা পরিষদের ১৪ সদস্যের মধ্যে অপর দুই পরাক্রমশালী রাষ্ট্র ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোটদানে নিজেদের বিরত রাখে। এতে করে পাকিস্তানের প্রত্যাশার শেষ আলোটুকুও ফিকে হয়ে যায়।

এদিন জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি বলেন, কোন শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চউ এন লাই ভারতীয় হামলার মুখে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ার কথা বলেন। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এই উত্তপ্ত অবস্থাতে যাতে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারিয়ে না ফেলেন সে জন্য মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতারে ভাষণ দেন।

মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডার চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে সব বিদেশি জাহাজগুলোকে বন্দর ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বিদেশি জাহাজগুলো এই সময় নিরাপত্তা চাইলে যৌথ কমান্ডার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। পৃথিবীর সব দেশ তখন বুঝতে পারে যে শীঘ্রই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতে যাচ্ছে। এই দিন লেফটন্যান্ট আরেফিনের নেতৃত্বে চালনা নৌবন্দরে এক তীব্র আক্রমণ সংঘটিত হয়। মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণের ফলে পাকবাহিনীর সব সৈন্য বন্দর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

জামালপুর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার, ঝিনাইদহ, সান্তাহার, ময়মনসিংহ ইয়ার্ড মিত্রবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দখল করে নেয় মিত্রবাহিনী। বাংলার উন্মুক্ত আকাশে মিত্র বাহিনীর বিমান অবাধে বিচরণ করে। জামালপুরে বিমান হামলায় কয়েকশ’ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।

মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের চারদিক থেকে বিজয় দেখে এগিয়ে যায়। মিত্রবাহিনীর বিজয় দেখে জেনারেল নিয়াজী পাকবাহিনীকে পেছনের দিকে সরে আসার নির্দেশ দেন। ভারতের অকৃত্রিম সাহায্য-সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সফলতা বাংলাদেশকে দ্রুত মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর হিসাবে, এদিন বারো ঘণ্টায় ২৩২ বারে ঢাকার তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে পঞ্চাশ টনের মতো বোমা ফেলা হয়েছে। এতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। পাকবাহিনীর কনভয়ের ওপর ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর নব্বইটা গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়া পাকবাহিনীর সৈন্য বোঝাই কয়েকটা লঞ্চ এবং স্টিমার ধ্বংস হয়।

সাবমেরিন গাজী পাক নৌবহরের গর্বের বস্তু। বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সফল আক্রমণে তা ধ্বংস হয়। সাবমেরিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে পাকিস্তান ধার হিসেবে পেয়েছিল।

নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের সব নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে বন্দর ত্যাগের পরামর্শ দেয়। তারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতেও তাদের অপারগতা প্রকাশ করে। বিশ্বের সব দেশ বুঝতে পারে বাংলাদেশের বন্দরগুলো রক্ষা করার ক্ষমতা আর পাকবাহিনীর নেই।

আরো পড়ুন: হানাদারদের ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ

মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট স্থলপথে এগিয়ে আসতে থাকে। প্রধান সড়ক দিয়ে না এগিয়েও মিত্রবাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কের কতগুলো এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও নাটোরের সঙ্গে ঢাকা ও রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

হানাদার বাহিনী যশোরের চৌগাছার সলুয়া বাজারে তৈরি করে অগ্রবর্তী ঘাঁটি। এ সময় যশোর সেনানিবাসের তিন দিকেই মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। প্রতিরোধ যুদ্ধের শেষ অভিযান চলে ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর। এ তিন দিন যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। সীমান্ত এলাকা থেকে মিত্রবাহিনী যশোর সেনানিবাসসহ পাক আর্মিদের বিভিন্ন স্থাপনায় বিমান হামলা চালায় ও গোলা নিক্ষেপ করে। ৫ ডিসেম্বর থেকে পর্যুদস্ত পাকবাহিনী পালাতে শুরু করে। এদিন সকাল ও দুপুরে পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের সঙ্গে ভারতীয় নবম পদাতিক ও চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রচন্ড লড়াই হয়।

বাংলাদেশ জার্নাল/এইচকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত