ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১০ মিনিট আগে
শিরোনাম

এনটিআরসিএ কি শিক্ষিত বেকারদের জন্য অভিশাপ?

  জাহিদ হাসান

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৮:৪৩  
আপডেট :
 ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:২৭

এনটিআরসিএ কি শিক্ষিত বেকারদের জন্য অভিশাপ?

সারা দেশের বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের জন্য ২০০৫ সালে গঠন করা হয়েছিল নন গভর্নমেন্ট টিচার্স রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড সার্টিফিকেশন অথরিটি বা এনটিআরসিএ। এমন সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি গঠিত হলেও তার কার্যক্রমের বিধি-বিধান সঠিকভাবে প্রণীত না হওয়ায় শুরুতেই বড় ধরনের ধাক্কা খায় প্রতিষ্ঠানটি। কয়েকটি উদাহরণ দিলেই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে যে এখনও প্রচুর ত্রুটি রয়ে গেছে, তা সবার কাছে পরিষ্কার হবে।

প্রথমত, এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম ব্যবস্থা ছিল পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সনদ প্রদান করা। পরবর্তীকালে সনদপ্রাপ্ত প্রার্থীরা নিজের এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটির মাধ্যমে চাকরিতে যোগ দেবে। কিন্তু এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা কমিটির অযোগ্য ঘনিষ্ঠজনরা উঠেপড়ে লাগে এসব চাকরি বাগিয়ে নিতে। দেখা গেছে, নিবন্ধন পরীক্ষায় অনেক বেশি নম্বর পেয়েও তারা চাকরি পায়নি স্বজনপ্রীতির প্রভাবে। তাছাড়া এনটিআরসিএ-র কতিপয় অসাধু ব্যক্তির বিরুদ্ধেও ছিল জাল সনদ বিক্রির বিস্তর অভিযোগ। এতে করে নিজেদের স্বচ্ছতা প্রমাণে নড়েচড়ে বসে এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ। তারা নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে থাকে। কিন্তু তারপরও ১ থেকে ১২তম শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার পুরনো গেজেটে সার্টিফিকেটের মেয়াদ, পরীক্ষার পদ্ধতি, উত্তীর্ণ প্রার্থীর সংখ্যা নিরূপণ, নিয়োগ প্রক্রিয়া ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যে একটা সঠিক পরিকল্পনার অভাব থেকেই যায়।

আরো পড়ুন: শিক্ষক নিবন্ধনে এসব কী হচ্ছে!

পরবর্তীকালে নিবন্ধনধারীদের নিয়োগদানের যে ক্ষমতা কমিটির হাতে ছিল, তা ২০১৫ সালের ২১ অক্টোবর থেকে দেয়া হয় এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষের কাছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। এতে করে কমিটির স্বজনপ্রীতির হাত থেকে রেহাই পায় এনটিআরসিএ। এরপর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান (এনআই খান) একটি গেজেট প্রণয়ন করেন, যা ২২ অক্টোবর ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। সেখানে উপরোক্ত যেসব সমস্যা ছিল, তার সঠিক জবাবসহ সবকিছুর বিস্তর বিধি যোগ করা হয়। এর আগে ১ থেকে ১২তম নিবন্ধনধারীদের অনেকেই হাইকোর্টে রিট করেছেন চাকরির জন্য। তাদের রিট করার একটি যৌক্তিক কারণও ছিল বটে। চাকরি পাওয়ার জন্য তারা একটি পরীক্ষার মাধ্যমেই এসেছে। এসব রিটের জবাব এখনও দিতে হচ্ছে এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু ২০১৫ সালের নতুন গেজেট অনুযায়ী এনটিআরসিএ-কে ঢেলে সাজানো হলেও কতটা সঠিক পথে হাঁটছে এ প্রতিষ্ঠান- তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

দ্বিতীয়ত, নিবন্ধন পরীক্ষার সার্কুলারে শূন্য পদের তালিকা প্রকাশ করা হয় না। যার ফলে বর্তমান গেজেটের আলোকে ১৩তম নিবন্ধনে অনেক পরীক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষা ভালো দিয়েও বাদ পড়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, অকৃতকার্যদের এলাকায় শূন্য পদ ছিল না। একজন পরীক্ষার্থী প্রিলিমিনারি পাস করার পর লিখিত পরীক্ষা দিয়ে জানতে পারল, তার উপজেলায় শূন্যপদ না থাকায় তাকে অকৃতকার্য ঘোষণা করা হয়েছে, অথচ এরই মধ্যে এই পরীক্ষা বাবদ সে প্রায় ২ হাজার টাকা ব্যয় করে বসে আছে! এনটিআরসিএ-র এহেন কার্যক্রম কি অন্ধকে হাতি দেখানোর মতো নয়?

বস্তুত এটি শিক্ষিত বেকারদের বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের পকেটের টাকা লুটে নেয়ার পন্থাও বটে। ১৩তম নিবন্ধন পরীক্ষায় ২০১৫ সালের গেজেটের (বিধি ৯-এর উপবিধি (২) এর খ-অনুযায়ী উত্তীর্ণ প্রার্থীদের যে শূন্য পদের বিপরীতে টেকানো হয়েছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর দীর্ঘ দেড় বছর এবং চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর ৬ মাস পার হলেও তাদের এখনও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। বরং শোনা যাচ্ছে, ১ থেকে ১৩তমদের মধ্যে থেকে বাছাই করে নিয়োগ দেয়া হবে। অথচ ১৩তমরা সর্বশেষ গেজেটের আলোকে পিএসসির আদলে নেয়া পরীক্ষায় শূন্য পদের বিপরীতে উত্তীর্ণ হয়েছে।

আরো পড়ুন: নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির জট খুলছে

তৃতীয়ত, এনটিআরসিএ আরেকটি উদ্ভট নিয়ম চালু করে রেখেছে। এমন নিয়ম বিশ্বের কোথাও, এমনকি বাংলাদেশের অন্যান্য চাকরির ক্ষেত্রেও নেই। এটি হল, নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান চয়েস বা ই-রিকুইজিশন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একজন নিবন্ধন উত্তীর্ণ প্রার্থীকে অনলাইনে প্রতিষ্ঠান চয়েস দিতে হয় আর একেকটি প্রতিষ্ঠানে চয়েস বাবদ তাকে টেলিটক সিমের মাধ্যমে পাঠাতে হয় ১৮৫ টাকা। আর যদি উত্তীর্ণ প্রার্থীর নিজের উপজেলায় ৫টি প্রতিষ্ঠানে তার বিষয়ের শূন্য পদ থাকে, তাহলে তাকে জমা দিতে হয় প্রায় ১ হাজার টাকা। আর নিজের উপজেলায় শূন্য পদ না থাকলে তাকে অনলাইনে আবেদন করতে হয় সারা জেলা/বিভাগ জুড়ে। কিন্তু এতেও চাকরি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা খুবই ক্ষীণ। ২০১৬ সালের ৬ জুনের ই-রিকুইজিশনে দেখা গেছে, অনেক নিবন্ধনধারী ৪০টির বেশি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেও চাকরি পায়নি। অথচ তাদের একেকজনকে জমা দিতে হয়েছে ৭ হাজার ৪০০ টাকা। এ প্রক্রিয়া কি শিক্ষিত বেকারের শরীর থেকে রক্ত চুষে নেয়া নয়?

চতুর্থত, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির সময়কাল নিয়েও ত্রুটি রয়েছে এনটিআরসিএ-র কার্যক্রমে। কারণ তারা প্রতিবছর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পরীক্ষা নিলেও উত্তীর্ণ প্রার্থীদের প্রতিবছর নিয়োগ দেয় না উপজেলায় শূন্য পদ না থাকার দোহাই দিয়ে। যেহেতু শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশগ্রহণে কোনো বয়সের বাধ্যবাধকতা নেই- অনার্স, মাস্টার্স ডিগ্রিধারীরা চাইলেই যে কোনো বয়সে এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে চাকরি পেতে পারে, তাহলে কেন প্রতিবছর এ পরীক্ষার সার্কুলার দেয়া হয়? বছর বছর সার্কুলার প্রকাশ করে আবেদন বাবদ কোটি কোটি টাকা পকেটে ভরা শিক্ষিত বেকারদের সঙ্গে তামাশা নয়?

পঞ্চমত, সনদের মেয়াদ নিয়েও কিছু ত্রুটি রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। কখনও আজীবন, আবার কখনও ৩ বছর করা হচ্ছে। এতে করে উত্তীর্ণ প্রার্থী পরবর্তী সার্কুলারে আবেদন না করে তার সনদের মেয়াদ থাকায় চাকরি পেতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়।

ষষ্ঠত, নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দান। এসব বিষয় থেকে বোঝাই যাচ্ছে, এনটিআরসিএ নামক প্রতিষ্ঠানটির পুরো প্রক্রিয়া শিক্ষিত বেকারদের পকেট কাটার ব্যবস্থা মাত্র। তাছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের কার্যপ্রণালীও গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য। এ সমস্যা উত্তরণে কিছু প্রস্তাবনা-

এনটিআরসিএ যেহেতু শিক্ষকের চাহিদা জেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে নিয়ে থাকে, সেহেতু প্রতিটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে দেশের সব জেলা শিক্ষা অফিস তাদের স্ব-স্ব ওয়েবসাইটে শূন্য পদের তালিকা প্রকাশ করবে। এতে করে যেসব প্রার্থী তার উপজেলায় শূন্য পদ দেখবে, সে আবেদন করবে এবং উত্তীর্ণ হলে চাকরি পাবে। আর শূন্য পদ না থাকলে আবেদন করবে না। এতে তার অর্থ ও ভোগান্তি দুটোই লাঘব হবে। আর কোনো উপজেলায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে অন্য উপজেলার প্রার্থীকে প্রতিষ্ঠান চয়েসের মাধ্যমে চাকরি দেয়া হবে এটিই স্বাভাবিক। তবে এ ক্ষেত্রে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ১০টি প্রতিষ্ঠান চয়েস দিতে পারবে ১৮৫ টাকায়। আর এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রাধান্য পাবে প্রার্থীর জেলা এবং বিভাগ- এ পদ্ধতি চালু করা হোক। সনদের কোনো মেয়াদ থাকবে না, অর্থাৎ একটি নিবন্ধন পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর সবাইকে নিয়োগ দান করে পরবর্তী সার্কুলার প্রকাশ করা। এতে করে সনদের মেয়াদ সংক্রান্ত কোনো জটিলতা না থাকায় প্রতিষ্ঠানটিকে মামলার ফাঁদে পড়তে হবে না। যেহেতু নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সবাই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পেরিয়ে আসে, তাই কাউকে নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং কাউকে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ না দিয়ে সবাইকে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া হোক।

সংশ্লিষ্ট মহল উপরোক্ত বিষয়াদি বিবেচনা করে এনটিআরসিএকে মামলার ফাঁদ থেকে মুক্ত করে গ্রহণযোগ্যতার উচ্চ শিখরে নিয়ে শিক্ষিত বেকারদের আশার আলো দেখাবে, এটি এখন সময়ের দাবি।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত