ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া জয় বানুর জীবিকার লড়াই

  অধরা ইয়াসমিন

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২১, ১৮:০১  
আপডেট :
 ১৬ আগস্ট ২০২১, ২০:২৪

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া জয় বানুর জীবিকার লড়াই

‘... কি যে আইলো এই করোনা। সবাইরে বেকার কইরা দিলো। আমাগোরে অহন না খাইয়াই মরতে হইবো। এই ঘর ভাড়া না দিলে আমাগোরে বাহির কইরা দিবো। মাংনা কেউ রাখে মা কন!’

মধ্য দুপুর। ঘরের মেঝেতে বসে একজন বৃদ্ধা লাল মরিচ চটকাচ্ছে। বড় ছেলে চৌকির উপর শুয়ে বুকের ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। ছোট নাতনি বই পড়ছে। কাছে যেতেই একটু নড়েচড়ে বসলেন তিনি। আপনি কি আমাদের সাথে খাইতে আইছেন, এইডি দিয়ে খাইতে পারবেন না বলে নিজেই বিলাপ করলেন তিনি।

লবন মরিচ চটকানো ও ভাত দিয়ে দুপুরের খাবারের আয়োজন করছিলেন তিনি। কথা হয়েছিলো রাজধানী ঢাকার কুনিপাড়ায় রাস্তার পাশে টিনশেডে বসবাসরত ৭৫ বছরের বৃদ্ধা ও ৩ সন্তানের জননী জয় বানুর সাথে।

ছেলের বয়স যখন পাঁচ তখন বিধবা হন জয় বানু। পরিবারের একমাত্র উপার্জন করা ব্যক্তিটি মারা যাওয়ায় পরিবারে নেমে আসে কষ্টের দিন। পরে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় নিজেকেই। মানুষের বাড়ি গিয়ে কাজ করতেন তিনি। এক ছেলে ও দুই মেয়েকে বড় করে তোলেন তিনি। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায়। বয়স বাড়তে থাকায় চোখে ছানি পড়ে গেলে আর কাজ করতে পারেনা জয় বানু। ভিটে বাড়ি ভেঙে গেলে উপার্জনের তাগিদে বড় ছেলের সাথে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন ২০০০ সাল থেকে।

মহামারি করোনায় চাকরি হারিয়ে দীর্ঘদিন বাসায় ছিলেন ছেলের বউ। তখন সংসার চলেছে কিভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে বাসায় থেকেছে। বেতন পায়নি তখন আমরা না খেয়ে থেকেছি মাঝেমাঝে। কিছু জমানো টাকা থাকায় ভিক্ষা করতে হয়নি। আমরা ক্ষুদার কষ্ট সহ্য করতে পারলেও আমার ছোট নাতনিটা কাঁদত। প্রতিদিন মরিচ ভাত খেতে পারে না। তিন নাতনি খাওয়ার জন্য কেঁদেছে কিন্তু কিছুই করতে পারি নাই’।

করোনায় কোন সাহায্য পেয়েছে কিনা সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই করোনায় কেউ সাহায্য করেনি। একদিন আইসিলো কাড়া যেনো হাত ধুইতে সাবান দিয়ে গেছে। খাইতে কেউ দেয় না গো মা।’

বিধবা হওয়ার আড়াইযুগ পরেও মেলেনি বিধবা ভাতার কার্ড। এই প্রসঙ্গে জয় বানু আক্ষেপ করে জানান, ‘কেউ কার্ড দেয়নি, সাহায্য করেনি। সবাই বলে গিরামের বাড়ি গিয়ে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বলতে। কিন্তু সেখানে আমার থাকার ভিটে বাড়িটা ভাঙ্গা। আমার ছেলে, ছেলের বউ আর তিন নাতনি ঢাহায় থাকে। ছেলে কাজ করতে পারে না। তাই ছেলের বউ আর আমার ছোট মাইয়াডা গার্মেন্টসে চাকরি করে। আমারেও তাদের সাথে রাখে। তাই বিধবা ভাতার কার্ড করে দেয় নাই মেম্বাররা।’

জয় বানুর ছেলে বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমি একজন খেটে খাওয়া মানুষ। আমার আরো ২ বোন আছে। এরমধ্যে এক বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি খুব অসুস্থ্য। আমার আলসারের সমস্যা থাকায় কিছুদিন কাজে যেতে পারিনি তাই চাকরিটা হারাই। এই করোনায় অনেকদিন যাবত বসে আছি। এখন আবার কাজও পাইনা। অনেকটা এই বাসা ভাড়া দিয়ে আর খাওয়ার টাকা থাকে না।’

তিনি আরো জানান, ‘আমি অসুস্থ থাকায় আমার বউ চার মাসের মেয়ে রেখে ডেইনিম গার্মেন্টেসে কাজে যায়। আমার মা আমার মাইয়ারে রাখে। নিজেরাই খাইতে পারি না। ছোট মাইয়ার লাইগা তোলা দুধ কেমনে কিনুম। সরকারী কোন সাহায্য আমাদের পর্যন্ত আসে না। কয়েকবার নাম নিয়ে গেলেও কোন সাহায্য আমরা পাই না।’

বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, জয় বানু তার পরিবারের সাথে এই বাড়িতে গত তিন বছর ধরে আছেন। এই বৃদ্ধার ছেলের চাকরি না থাকায় কোন রকম দিন পার করছেন তারা। এই করোনা মহামারীর মধ্যে ছেলের বউ আর ছোট মেয়ের উপার্জনই যেন তাদের ভরসা।

বাংলাদেশ জার্নাল- বিএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত