ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

ইউপি নির্বাচন ও কর্পোরেট দানব

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৫৮  
আপডেট :
 ২৫ নভেম্বর ২০২১, ১৭:০০

ইউপি নির্বাচন ও কর্পোরেট দানব

শীত আসি আসি করেও আসছে না! খুবই লজ্জা তার! এক পা এগোয়তো, দু'পা পেছোয়! অঘ্রানের প্রথম পক্ষ যাই যাই করছে-যাওয়ার আগে শীত বুড়ির হাতে প্রকৃতি শাসনের ব্যটন তুলে দিতে চায়। কিন্তু শীত বুড়ির আচরণ প্রত্যন্ত গ্রামের কিশোরি নববধুর চে'ও আড়ষ্ট! এত্তো লজ্জা! অঘ্রানের বাড়তি আদর এবং টানা-হেচড়ার পরও চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকবে না! বেশ ক'বছর ধরে এমন আজব আচরণ শীতের। যদিও পৌষ-মাঘ এই দুমাসকে শীত ঋতু বলা হয়। হলেও ছয় ঋতু বৈচিত্র্যের প্রিয় দেশে এখন মাত্র তিন ঋতুই রাজদন্ডের মালিক। তারাই বছরজুড়ে ছড়ি ঘুরায়। এদের নাম না বল্লেও সবাই জানে। গ্রীস্ম, বর্ষা ও শীত। বাকি তিন ঋতু কেতাবে মানে কবিতা ও সাহিত্যের অলঙ্কার হয়ে বেঁচে আছে। এর বাইরে তাদের আরেকটা বাড়তি কাজ, তিন প্রধান ঋতুর মাঝখানের সংযোগ সেতু যোজনা। এই তিন ঋতু শরত, হেমন্ত ও বসন্ত। অথচ বসন্ত ঋতুরাজের জীর্ণ পোষাক পরে রাজ্যহারা রাজা মাত্র!

শরতের কাজ পেছনের বর্ষাকে বাড়তি স্পেস তৈরি করে দেয়া। বর্ষা যতটুকু সম্ভব স্পেস আরো বাড়িয়ে নিচ্ছে। আর হেমন্ত পেছনের শরতকে হাল্কা কুয়াশার চাদর, সাদা মেঘ ভেলা ও কাশফুলের শোভা দিয়ে খানিক সোহাগী স্পেস ছেড়ে দেয়। যাতে শরত দাবি করার সুযোগ পায়, সে আছে বর্ষ পঞ্জিকায়। চাইলেই কেউ আসন কেড়ে নিতে পারবে না। হেমন্ত না ঘরকা না ঘাটকা! তার খানিকটা দান করতে হয় শরতকে, বাকিটা শীত-গ্রীস্মের টানাপোড়েনের চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা! ধান কাটার মৌসুম থাকায় তার খানিক রূপের খোলতই হয়। নিজের উপস্থিতির জৌলুস জানানোর সুযোগ পেয়ে যায়। না হলে বাঙালি বাংলা নববর্ষ ছাড়া বাংলা সনের মাস তারিখ মনেই রাখে না! হালে গ্রামের ফসল তোলার নবান্ন উৎসব নগরীতে স্থান পরিবর্তন করায় শহরেও তার দু'একদিন বাড়তি কদর হচ্ছে। কিন্তু উৎসবের মূল উৎস গ্রামের শিশুরা নবান্ন নামে যে, একটা অসাধারণ আনন্দ আয়োজন ছিল তা কবেই ভুলে গেছে। বসন্তের শুরুর ক'দিন শীতের এক্সটেনশন ছাড়া বাকি পুরোটায় গ্রীষ্মের একক দখলদারি কায়েম হয়েছে। তবুও রাজধানীসহ বড় নগরে বসন্ত মেলার সাড়ম্বর আয়োজন ও শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার চোখ ধাঁধানো রঙের সাজ বসন্তের রাজকীয় ঐতিহ্যের পতাকা উঁচিয়ে রেখেছে।

ঋতুর সাতকাহন না, আসলে রাজনীতির উত্তাপকে আরো সুস্বাদু আমেজ দিতেই ঋতু স্যুপের ডিশ পরিবেশনা। দেশজুড়েই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের এখন টানটান উত্তেজনা। একসাথে চলছে, পাকিদের সাথে ক্রিকেট সিরিজ। টি-২০ শেষ, ফলাফল ধবল ধোলাই! টেষ্ট সিরিজ শুরু হচ্ছে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। ফলাফল আল্লাহ ভরসা! আপাতত দোয়া ইউনুস পড়ছি, সাথে কুলহুআল্লাহ পড়ে বুকে থুতু ছাড়া ফু'ও! ক্রিকেট ধ্বসের সাথে ইউপি নির্বাচনী উত্তেজনা ও খুনোখুনিটা মিলেমিশে একাকার! চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের সবচে' গুরুত্বপূর্ণ মাঠ পর্যায়ের এই নির্বাচনে প্রথম দু'কিস্তির ভোটে প্রচুর রক্ত ঝরেছে। বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন, লুট ও ভাঙচুরের ঘটনাও বিস্তর। ২৮ নভেম্বর হবে তৃতীয় কিস্তির নির্বাচন।

এবারের নির্বাচনেব সবচে' গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মাঠ পর্যায়ে সরকারি দলের বিভক্তি। ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের বিরোধ। ২০০ এর বেশি চেয়ারম্যান বিনাভোটে নির্বাচিত হওয়া এবং নৌকা প্রতীক না পেয়ে বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিপুল জয়। এমন কেন ঘটেছে? দুই কিস্তির নির্বাচনের শব ব্যাবচ্ছেদ করলে নিশ্চয়ই উপসর্গ চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। এটাও সত্য বিরোধী দল তথা বিএনপি-জামাত জোট নির্বাচন বর্জন করলেও তলে তলে ভালোই ঘোট পাকিয়েছে। বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্রকে বাজির দান হিসাবে ভালোই ব্যবহার করেছে তারা। জিতেও এসেছে অনেকে।

উপজেলা ও জেলার তালিকা বাছাই করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড প্রার্থী বাছাই করে মনোনয়ন দেন। তালিকা তৈরি ও মনোনয়নে বিপুল বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে বলেও আলোচনা সমালোচনা বিস্তর। একজনকে প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার পর শেষ মুহূর্তে বাতিলের ঘটনা বিতর্কের বাস্পকে কুঞ্জটিকা বানিয়ে দিয়েছে। কোটি টাকার বেশি দামে যদি ইউপি চেয়ারম্যান প্রতীক বাণিজ্য হয়, তাহলে রাজনীতি দুষণের ক্ষতটা কত ভয়ঙ্কর ভাবতেই আতঙ্ক হয়। এই ভয়াল ক্ষত কেন তৃণমূলে ছড়িয়ে দিলেন সরকারি দলের নীতিনির্ধারকেরা, জানি না?

রাজনীতি নামের পণ্যটি কতো আকর্ষণীয় এবং ক্ষমতার উৎস তার আলামত কুৎসিতভাবে ফুটে উঠেছে প্রতীক লাভের এই প্রতিযোগিতায়। রাজনীতি আসলে এক বিশাল লাভজনক কর্পোরেট বাণিজ্য তা আমাদের জাতীয় তথা সংসদ নির্বাচন ঘিরে বনেদি, অনুপ্রবেশকারী, সাবেক আমলা ও কর্পোরেট রাজনীতিকদের অস্বাভাবিক মনোনয়ন দৌড়ে স্পষ্ট হয়েছে অনেক আগে। নীতি-আদর্শ ও জনকল্যাণ বিমুখ রাজনীতি কতো অসুন্দর হয়, নতুন করে তার প্রদর্শনী দিল ইউপি নির্বাচনের চেয়ারম্যান প্রার্থীর নৌকা প্রতীক। দেশের রাজনীতিতে একটি লোভনীয় বা লাভজনক পদ পাওয়াই, কারো কারো একমাত্র টার্গেট, জনকল্যাণ বা নীতি-আদর্শ চর্চা নয়, তা নোংরাভাবে ফুটে উঠছে বারবার।

এর জন্য দায়ী ক্ষমতার রাজনীতির লাগামহীন সুবিধা ও অন্যায্য প্রাপ্তিযোগ। রাজনীতির দুষণ সমাজ ও রাষ্ট্রের সবক্ষেত্র বিশেষ করে কর্পোরেট, আর্থিক ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানকেও কলুষিত করেছে। শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, মিডিয়া কোন সেক্টরেই এখন ন্যূনতম শুদ্ধতা নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শের ছাতা মেলে ধরে তাঁকেও খাটো করা হচ্ছে। টিভি চ্যানেলের জমজমাট টকশোগুলোয় যে ব্যক্তিরা গলার রগ ফুলিয়ে টানা শব্দ দূষণ করছেন, তা মানুষকে নাটক, সিনেমার চে'ও বেশি বিনোদিত করছে। আমরা ভুলে গেছি, আমাদের পরিবার আছে, সন্তান আছে! তারা আমাদের দ্বিচারিতা, মিথ্যাচার, লোভ, অন্যায় খুব কাছ থেকে দেখছে। পিতা-মাতার পবিত্র অবস্থানকে আমরা কলুষিত করছি। সন্তানের মনে আমরা রোল মডেলের বদলে খলনায়ক বা দানবের অবস্থান পোক্ত করছি। আমরা তাদের মনোজগতে হয় দানব অথবা ভাঁড় হিসাবে স্থায়ী আসন গেঁড়ে বসছি! তারা আমাদের দ্বিচারিতাকে ঘৃণা করছে- প্রচণ্ড ঘৃণা! এই ঘৃণার আগুন আমাদের সব অন্যায় অর্জনকে পুড়ে ছাই করে দেবে! সীমিত জীবনে ধন আর ক্ষমতার দামে আত্মজদের ঘৃণা কেনাই কী আমাদের শেষ পরিণতি? জীবনতো খুবই ছোট্ট! এই ছোট্ট জীবনে বিশাল দামে আত্মজদের ঘৃণা থেকে বাঁচতে আমরা কি দেশ, মানুষ ও মানবতার কল্যাণে নিজেদের নিবেদিত করতে পারি না?

প্লিজ যে অবস্থানেই থাকিনা কেন, আসুন না একবার অন্তত বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়াই! নিজকে প্রশ্ন করি, ভালো মানুষের খোলসে কেন আমি অতিকায় কর্পোরেট ভোগ দানবকে লালন- পালন, তোষণ করে যাচ্ছি? আমি কেন মানুষের-আত্মজের ঘৃণা নিয়ে মরবো? না, হবে না- আমাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবেই হবে!

লেখক: মোস্তফা কামাল পাশা, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • পঠিত