ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য

মৌলবাদীদের ‘আস্ফালনে’ নীরব আওয়ামী লীগ

  শেখ তৌফিকুর রহমান

প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২০, ২১:১৫  
আপডেট :
 ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ১৯:২৬

মৌলবাদীদের ‘আস্ফালনে’ নীরব আওয়ামী লীগ
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকক্ষের সামনে ভাস্কর্য। ছবি: সংগ্রহ।

রাজধানীর ধোলাইপাড় মোড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে অনির্মিত সেই ভাস্কর্যকেই মূর্তি আখ্যা দিয়ে তা বন্ধের দাবি তুলেছে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী। সেই সঙ্গে যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করে তারা বঙ্গবন্ধুর সু-সন্তান হতে পারে না বলেও আপত্তিকর মন্তব্য করেছে। এমনকি ভাস্কর্য স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল করা না হলে তৌহিদি জনতা আন্দোলনে নামবে বলেও হুমকি দেয়া হয়েছে।

তবে কট্টরপন্থী ইসলামিক দলগুলোর এমন বিতর্কিত দাবির বিরুদ্ধে তেমন জোরালো কোনো প্রতিবাদ বা কর্মসূচি হতে দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের হাতে গোনা নেতাসহ সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী গণমাধ্যমে প্রতিবাদ জানালেও দলীয়ভাবে নীরবতাই দেখা গেছে। ওলামা লীগ ছাড়া মূল দল আওয়ামী লীগ কিংবা সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও কোনো প্রতিবাদ হয়নি। তারা সবাই মূল দল আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

তবে দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন, বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছেন। তবে মৌলবাদিদের বিরুদ্ধে কর্মসূচি দেয়ার সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। ফলশ্রুতিতে বিষয়টির বিরুদ্ধে মাঠে ময়দানে কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি বা সমাবেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

অবশ্য আওয়ামী লীগ সমর্থিত বেশ কিছু সামাজিক সংগঠন এরই মধ্যে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের বিতর্কিত দাবির বিরুদ্ধে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সমাবেশও করেছে। আগামীতেও কর্মসূচির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর অনির্মিত ভাস্কর্য অপসারণে আগাম দাবি তুলে এক সমাবেশে চরমোনাইর পীর ও ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেন, ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনের চক্রান্ত তৌহিদি জনতা রুখে দেবে। রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে মূর্তি স্থাপনের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে ফিরে আসতে হবে। মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তৌহিদি জনতার আন্দোলন চলবে।

মুফতি ফয়জুল করীম সরকারকে হুমকি দিয়ে বলেন, ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন থেকে সরকার সরে না এলে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবেন তারা। একইদিন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হক ঢাকায় খেলাফত যুব মজলিসের এক অনুষ্ঠানে একই সুরে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি করার শামিল। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করে তারা বঙ্গবন্ধুর সু-সন্তান হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু একজন মুসলিম হিসেবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তার মূর্তি তৈরি করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্থাপন করা হলে তা হবে বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে বেইমানি।

কট্টরপন্থীদের এমন বক্তব্যের পর পরই আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অনেকেই মনে করেন, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যতা এবং ধর্মভিত্তিক দল বা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সমঝোতা করে চলার সুযোগ নিয়ে কট্টরপন্থীরাই আওয়ামী লীগের স্পর্শকাতর বিষয়ে আঘাত করছে।

দলটির সঙ্গে ঘনিষ্ট বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত বিষয়ে আঘাত আসার পরও আওয়ামী লীগের নীরবতা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিনাত হুদা আন্তর্জাতিক এক গণমাধ্যমকে সম্প্রতি বলেছেন, বিক্ষুব্ধ প্রবল স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ধর্ম নিরপেক্ষতার বিষয়টি এনেছিলেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিষয়কে এনেছিলেন। আজ আমরা যারা অগ্রসরমানতার কথা বলি, নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি, তারা পিছিয়ে গেলে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে।

ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, যারা এদেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়, তাদের কখনোই ছাড় দেয়া হবে না। দেশের স্থিতিশীল পরিবেশকে যারা অস্থিতিশীল করতে চায় তাদের হুশিয়ার করতে চাই। ছাত্রলীগের অবস্থান সব সময়ই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। আমরা প্রতিটি জায়গায় বলেছি যারা উসকানি দিয়ে এদেশের পরিবেশকে নষ্ট করতে চায় তাদের ছাড় দিবো না।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবির প্রতিবাদে ছাত্রলীগের কর্মসূচি প্রসঙ্গে জয় বলেন, নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরই মধ্যে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। আগামীতে কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে।

কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলসুম বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আমরা অবশ্যই প্রতিবাদ করবো। দলগতভাবে প্রতিবাদ না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা তো আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণীর ব্যাপার। আওয়ামী লীগ বিবৃতি দেবে কিনা সেটা তো বলতে পারবো না।

এ প্রসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু বলেন, আমরা অবশ্যই এটার প্রতিবাদ করি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য যারাই ষড়যন্ত্র করবে তাদের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়াবো। তিনি মনে করেন স্থাপত্য পৃথিবীর সব মুসলিম রাষ্ট্রে আছে। এগুলোকে ভেঙে ফেলার অর্থ রানৈতিক স্ট্যান্টবাজি ছাড়া কিছুই না। এখানে ধর্ম রক্ষার কোনো বিষয় নেই। ধর্মান্ধরা রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি সারাজীবনই করে আসছে। এতে দেশের মানুষের কিছু আসে যায় না।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক লীগের অবস্থান বিষয়ে জানতে চাইলে আফজালুর রহমান বাবু আরো বলেন, এটার বিরুদ্ধে আমরা অবশ্যই প্রতিবাদ করি। বঙ্গবন্ধু কন্যার অনুসারীরা সব সময়ই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার। দরকার হলে অবশ্যই কর্মসূচি দেব। এরই মধ্যে আমাদের প্রোগ্রামগুলোতে এর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছি। সম্প্রতি সিলেটে তিনের দিনের প্রোগ্রাম করেছি। সেখানে প্রতিটি কর্মীসভায় ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসার‌ণের দা‌বি‌র বিরু‌দ্ধে এখ‌নো নিশ্চুপ যুবলীগ কোনো প্রতিবাদ কিংবা বিবৃ‌তি সংগঠন‌টির পক্ষ থে‌কে দেয়া হয়‌নি। এ প্রস‌ঙ্গে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল বাংলা‌দেশ জার্নাল‌কে ব‌লেন, এখ‌নো কোনো সিদ্ধান্ত হয়‌নি। দলীয় হাই কমা‌ন্ডের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভি‌ত্তি‌তে সিদ্ধান্ত নেয়া হ‌বে।

ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি বলেন, দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ার আগে মন্তব্য করতে পারবো না। আগে দল মন্তব্য করবে, তারপরে সিদ্ধান্তটা নিতে পারবো।

বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য অপসারণের দাবিতে করা সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান পরিষ্কার করেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, দলের নেতাকর্মী ও মন্ত্রীরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে। এটা তো দলের কথাই। ওদের নিয়ে ও রকম ভাবনা নেই যে, কর্মসূচি দিতে হবে, আন্দোলন করতে হবে। এ রকম চিন্তা করি নাই। কারণ সমসাময়িক করোনা পরিস্থিতির মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে অত বেশি ভাবনা নেই।

আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আরো বলেন, জাতির পিতার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার দায়িত্ব কর্তব্য দেশের জনগণের। বাঙালিরা জাতির পিতাকে যে জায়গায় অধিষ্ঠিত করেছে, সেই জায়গা নষ্ট করার ক্ষমতা কারো নেই। যদি কোনো গোষ্ঠী, ধর্মব্যবসায়ী বা জাতির পিতার হত্যাকারীর প্রতিভূ, যারা বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শকে প্রতিদিন হত্যা করতে চায়, মূলত তারাই বঙ্গবন্ধুর সম্মানকে ক্ষুন্ন করতে তার জন্মশত বার্ষিকীতে এ ধরণের কথাবার্তা বলছে। এসব অপচেষ্টার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। এদের প্রতিহত করার প্রয়োজন হলে অবশ্যই জনগণকে সঙ্গে নিয়েই করবো।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএম

  • সর্বশেষ
  • পঠিত