ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৯ মিনিট আগে
শিরোনাম

‘নীল তিমি’র আদ্যোপান্ত

  আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০১৭, ১২:৪৫  
আপডেট :
 ০৯ অক্টোবর ২০১৭, ১২:৪৯

‘নীল তিমি’র আদ্যোপান্ত

এক ফেসবুক বন্ধু তার আত্মীয়কে নিয়ে ব্লু হোয়েল দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তিনি এ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমার ব‍্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, সাধারণ মনস্তাত্ত্বিক দিক উপেক্ষা করে অসম্পূর্ণ, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে বিশ্বের বড় বড় মিডিয়া আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি করেছে যার ফলে সুইসাইডাল চ‍্যালেঞ্জের এ গেমটি আরও বেশি প্রসার ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তাই এ গেমটি সম্পর্কে আসলেই সচেতন হওয়া উচিত। এই গেমের সহজলভ্য তথ‍্যগুলো অনেকে জানেন। সংশ্লিষ্ট অন‍্যান‍্য কিছু তথ্য দেয়ার চেষ্টা করছি।

ব্লু হোয়েল নামকরণ:

ডলফিন ও নীল তিমিদের মধ্যে আত্মহত্যা করার ঘটনা ঘটেছে বিশ্বের অনেক স্থানে। নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল‍্যান্ডে এক সঙ্গে অনেক নীল তিমির আত্মহত্যা আলোচিত ঘটনা। এরা ঝাঁকে ঝাঁকে সমুদ্র সৈকতে উঠে আসতে থাকে। কিছু সময় পর ডাঙ্গায় মৃত্যু হয় তাদের। জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে নিস্তার পেতে আত্মহত্যা করে নীল তিমি। যেহেতু মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের মতো সামাজিক জীবন অতিবাহিত করে তাই একজনের কারণে অন‍্যরাও আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। উল্লেখিত দুটি কারণের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে নীল তিমি বা ডলফিনের স্বেচ্ছা মৃত্যুর কারণ এখনো রহস‍্যাবৃত।

আত্মহত্যার মিশন নিয়ে সাজানো গেমটির ব্লু হোয়েল নামকরণের কারণ এটি বলে জানা যায়।

গেমের সূত্রপাত

শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম, মেধাবী ও যোগ‍্যতর আর্য জাতির মানুষেরা বেঁচে থাকবে ও তারাই বংশ বিস্তার করে উন্নততর বৈশিষ্ট্যের মানুষ জন্ম দিবে এ থিওরিকে বলা হয় ইউজেনিক্স বা সুপ্রজনন বিদ‍্যা। হিটলারের নাৎসি বাহিনী এর পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন শুরু করেছিল। এমন ধারণার ভিত্তিতে ২০১৩ সালে রাশিয়ায় ফিলিপ বুদেকিন নামে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত মনোবিজ্ঞানের এক ছাত্র এই গেমটি তৈরি করে। জুটে যায় আরও কয়েকজন সমমনা। বলা বাহুল্য যে, যারা আত্মহত্যা করে তারা মানসিকভাবে দুর্বল থাকে। ব্লু হোয়েল গেম নির্মাতাদের মতে, দুর্বল মানসিকতার মানুষদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই। তাদের হত্যা না করে তারা নিজেরা যেন আত্মহত্যা করে সেই লক্ষ্যে সাজানো হয় ৫০ দিনের সুইসাইড চ‍্যালেঞ্জ। শুরুতে তারা মানসিকভাবে দুর্বল মানুষদের চিহ্নিত করে এ খেলাটি পাঠাতে শুরু করে। জানা যায়, রাশিয়ার ১১৮ জন এ গেম খেলে আত্মহত্যা করে। পরবর্তিতে সোশ‍্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের অন‍্যান‍্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

কিছু ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর বিষয়

১. এ গেমটি মুছে ফেলা যায় না। মনস্তত্ত্ব আর তথ‍্য প্রযুক্তি ভিন্ন বিষয়। রাশিয়ার প্রোগ্রামাররা মেধাবী সন্দেহ নেই। কিন্তু গেম আনইন্সটল বা ডিলিট হবে না এর ভিত্তি নেই। কোনো থার্ড পার্টি সফটওয়্যার রিড অনলি মেমরি ব‍্যবহার করে না যে সরানো যাবে না। আমি নিজে গেমটি আনইন্সটল করেছি।

২. সকল নিয়ন্ত্রণ তারা নেয়, ব্ল‍্যাক মেইল করে। এটাও ভুল। যেমন: একটি ধাপে নুড ছবি পাঠাতে বলে। এর মাধ্যমে রাশিয়ার কয়েকজনকে ব্ল‍্যাকমেইল করা যাবে হয়তো। কিন্তু এজন্য কেউ জীবন দিবে তা যুক্তিতে পড়ে না।

৩. কেউ বলছে আত্মহত‍্যার আগে উদাস হয়ে গিয়েছিল, কেউ বলছে পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে শুরু করেছিল। পারিবারিক বন্ধনে থেকে উদাস - পরস্পরবিরোধী নয়? এভাবে আরও প্রসঙ্গ আনা যায়। তবে গেমের এডমিনদের কনসার্ন শুধু মনস্তাত্ত্বিক দিক।

বিতর্কিত আত্মহত্যা

ভারতের মাদুরাই সহ আত্মহত্যার কয়েকটি ঘটনায় দেখেছি, ভালো স্মার্ট ফোন বা ট‍্যাব/ল‍্যাপটপ কেনার মতো আর্থিক সক্ষমতা নেই এমন পরিবারের লোকজনকে ব্লু হোয়েল খেলার কারণে আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেছে সাংবাদিকরা। অথচ সেই পরিবারের কারো কোনো গেম সম্পর্কেই অভিজ্ঞতা নেই। মাত্র ১০ ফুট উঁচু থেকে আত্মহত্যা করেছে এমন দাবিও রয়েছে। কেউ কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং/অথবা অপ্রীতিকর ঘটনা চাপা দিতে ব্লু হোয়েল খেলার কথা বলে। এ দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে কিছু কাজের বর্ণনা দেয়। প্রকৃতপক্ষে এ খেলার শেষের ধাপগুলোতে তারাই যেতে পারে যারা কোনো তথ্য লিক করবে না।

কী টাস্ক দেয়া হয়?

পাঁচ মিনিট হাঁটা, মুভি দেখা - এমন সাধারণ কাজ থেকে শুরু করে হাত কাটা বা তেলাপোকা/বিড়াল/কুকুর হত‍্যা বা ছাদে দাঁড়ানোর মতো কাজ দেয়া হয়। এটি মূলত কমিউনিকেশন প্রোগ্রাম যা অন্যান্য গেমের মতো জটিল প্রোগ্রামিং দিয়ে করা নয়। এখানে এডমিন সরাসরি টাস্ক দেয় তাই তার পরিচয় গোপন অন‍্যতম বিবেচ‍্য। মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ভিন্ন ভিন্ন টাস্ক দেয়া হয় যার মাধ্যমে তার বেঁচে থাকাকে মূল‍্যহীন মনে করে। শেষ পনেরটি ধাপ সম্পর্কে কোনো তথ্য আছে বলে আমার জানা নেই। ধারণা করা হয় অনেককে এভাবে মোটিভেট করা হয় যে মৃত্যুর পর নতুন আরেকটি সুন্দর জীবনের শুরু হবে।

মূল রহস্য

বছরে ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে গড়ে ১৩ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। নারীর তুলনায় পুরুষদের এ প্রবণতা সাড়ে তিন গুণ বেশি থাকে। মূলত কিশোর বয়সে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একাধিক চেষ্টার পর একজন মানুষ আত্মহত্যা করে।

মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাকে পুঁজি করে সাজানো হয়েছে ব্লু হোয়েল গেমটি। অর্থাৎ যাদের এমন প্রবণতা আছে তারা আকৃষ্ট হবে। কারো আত্মহত্যার সুপ্ত ইচ্ছা জাগ্রত হবে। আর এজন্য প্রচারণার যে প্রয়োজন তা বিনামূল্যেই করছে মিডিয়াগুলো। ভিত্তিহীন প্রমাণ করতে একটি পরিসংখ্যান যথেষ্ট বলে মনে করি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে বছরে চুয়াল্লিশ হাজার। গত চার বছরে আত্মহত্যার ঘটনায় সারা বিশ্বে ব্লু হোয়েলের নাম এসেছে দুই বা তিনশটি ঘটনায়। আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল না কিন্তু এ খেলার কারণে করেছে এমন দৃষ্টান্ত কতটি আছে আমি সন্দিহান!

এ পৃথিবী এতটাই বাণিজ্যিক হয়ে গেছে যে জীবন-মৃত‍্যু সবকিছুর মূল‍্য নির্ধারিত হয়। যেমন অনেকে দাবি করেন প্রাণঘাতী রোগের প্রতিষেধক ছাড়া হয় না, এ খাতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ও লাভে প্রভাব পড়বে বলে। ব্লু হোয়েল প্রচারণা শুধুই নেতিবাচক বিনোদনের একটি উপাদান। যে আত্মহত্যা করবে তার জন্য ব্লু হোয়েল একমাত্র উপলক্ষ্য নয়। এ প্রবণতা মানসিক যা স্নেহ, মায়া, মমতা ও পারিবারিক বন্ধন দিয়ে নিরাময় করা সম্ভব।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত