ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

হৃদরোগ হাসপাতালের এত ডাক্তার-নার্স করোনায় আক্রান্ত কেন?

হৃদরোগ হাসপাতালের এত ডাক্তার-নার্স করোনায় আক্রান্ত কেন?

ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের একের পর এক ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মী কোভিড-১৯য়ে আক্রান্ত হচ্ছেন। জানা যায়, এ পর্যন্ত ওই হাসপাতালের ১৫ জন ডাক্তার-নার্সসহ মোট ২৯ জন চিকিৎসাকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এই হাসপাতালে করোনা ছড়িয়েছে এক রোগীর মাধ্যমে।

সপ্তাহ তিনেক আগে একজন রোগী হৃদরোগ হাসপাতালে এসেছিলেন হার্টের সমস্যা নিয়ে। তিনি হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন ১০ দিন ধরে। এক পর্যায়ে তার দেহে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়। এরপর থেকে করোনায় আক্রান্ত হতে থাকেন ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা। জানা যায়,যারাই কোনও না কোনভাবে ওই রোগীটির সংস্পর্শে গিয়েছিলেন, তারা প্রত্যেকেই আক্রান্ত হয়েছেন।

এখন বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি এই বিশেষায়িত হৃদরোগ হাসপাতালটির আটটি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে একটিকে লকডাউন করে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার একজন সহকারী অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসক। তবে তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি।

বিবিসি বাংলার সঙ্গে কথা বলার সময় ইনস্টিটিউটের পরিচালক মীর জামালউদ্দীন জানান, সব মিলিয়ে ওই হাসপাতালের ২৯ জন চিকিৎসাকর্মী সংক্রমিত হয়েছেন। তবে তিনি লকডাউনের ব্যাপারটি স্বীকার করেননি।

সেখানকার যে ২৯ জন করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন তাদের মধ্যে আটজন ডাক্তার ও সাতজন নার্স। একজন নার্সের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় আগেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো। এখন আরো একজন ডাক্তারের অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে বুধবার হাসপাতালে ভর্তি করা হবে বলে জানিয়েছে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ। বাকিদের বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সনাক্ত হয়েছে মোট ৭১০৩ জনের। এদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন মোট ১৫০ জন। আর ১৬৩ জন মারা গেছেন।

গোটা বাংলাদেশের মধ্যে শুধুমাত্র এই হাসপাতালটিতেই ভাসক্যুলার সার্জারি করার ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ শরীরে যেকোনো অংশে আঘাত লেগে বা কেটে গিয়ে যদি কোন ধমনী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জরুরি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা সারিয়ে তোলার ব্যবস্থা একমাত্র হৃদরোগ ইন্সটিটিউটেই আছে।

এছাড়া সারা বাংলাদেশ থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষেরা এই হাসপাতালে আসেন, যাদের জীবন বাঁচানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা দেয়া বা অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন পড়ে। ফলে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার কারণে এই হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা যদি ব্যহত হয়, তাহলে বহু মানুষের জীবন সংশয় তৈরি হতে পারে।

পরিচালক মীর জামালউদ্দীন জানান, একজন রোগীর মাধ্যমেই সেখানকার ২৯ জন চিকিৎসাকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র চিকিৎসক বিবিসি বাংলাকে জানান, আক্রান্তদের মধ্যে ১৫ জন ডাক্তার-নার্স ছাড়াও রয়েছেন একজন ওয়ার্ড মাস্টার, জনাকয়েক ওয়ার্ডবয় এবং নিরাপত্তারক্ষীসহ অন্যান্য সহায়তা কর্মী। এরা সবাই ওই রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন, যাদেরকে পরবর্তীতে কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের অনেক হাসপাতালেই এখন রোগী ভর্তি করার আগে 'করোনাভাইরাস নেই' এমন সার্টিফিকেট দেখতে চাওয়া হয় বলে জানা গেছে।

কিন্তু পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এই চিকিৎসক বলেন, হৃদরোগ এমন এক সমস্যা, যার চিকিৎসা শুরু করতে হয় অনতিবিলম্বে। নয়তো তার বড় ক্ষতি, এমনকি জীবননাশের হুমকি তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে ভর্তি করার আগে তার সংক্রমণ আছে কি-না, তা পরীক্ষা করে দেখার কোনও সুযোগই থাকে না।

হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক জানান, এখন পর্যন্ত তারা মোট ১০ জন করোনা রোগী পেয়েছেন। তাদের করোনা হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। শুধুমাত্র একজন রোগীর ক্ষেত্রে বিষয়টি আগেভাগে ধরতে না পারার কারণে তিনি বহু চিকিৎসাকর্মীকে আক্রান্ত করে ফেলেছেন।

তবে বড় এই হাসপাতালের ক্যাম্পাসটির আরো দুই জায়গায় দুজন কর্মীর কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে, যারা ওই রোগীর সংস্পর্শে আসেননি। এদের একজন হাসপাতালের ফার্মেসির একজন কর্মী। আরেকজন নিরাপত্তা রক্ষীদলের একজন আনসার সদস্য। ফলে আনসার সদস্যরা বিশ্রাম নেয় এমন একটি জায়গাকেও লকডাউন করা হয়েছে। আর ফার্মেসিটিকে প্রায় ১৬ দিন লকডাউন রাখার পর দিন কয়েক আগে খুলে দেয়া হয়েছে।

মোট শনাক্তের প্রায় ৭ শতাংশই ডাক্তার

বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠনের হিসেব অনুযায়ী, দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৪৪০ জন ডাক্তারের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। সব মিলে মোট শনাক্ত রোগীর মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশই ডাক্তার। আর মোট নার্স আক্রান্ত হয়েছেন ২৩৫ জনের মতো।

করোনায় আক্রান্ত ডাক্তার-নার্সদের অধিকাংশই এমন সব হাসপাতালে কর্মরত, যেখানে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয় না। বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে বহু চিকিৎসাকর্মীর আক্রান্ত হবার ঘটনা ঘটেছে এর আগে।

এ পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলেছেন ডক্টরস ফাউন্ডেশনের প্রধান সমন্বয়ক ডা. নিরুপম দাশ। তিনি বলেন, ‘এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে যারা নন-কোভিড রোগী, তাদের চিকিৎসাসেবা অচিরেই হুমকির মুখে পড়ে যাবে।’

সুরক্ষা উপকরণের সংকট

সরকারের তরফ থেকে এ কথা বলা হচ্ছে যে সুরক্ষা উপকরণের কোন অভাব নেই এবং সব চিকিৎসাকর্মীদেরই পর্যাপ্ত সুরক্ষা উপকরণ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেছেন, দশদিন আগেও তাদের পিপিইর মতো কোন সুরক্ষা উপকরণ দিচ্ছিল না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ার ঘটনার পর থেকে অর্থাৎ দিন দশেক আগে থেকে পিপিই সরবরাহ শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেগুলো পর্যাপ্ত নয় এবং এগুলো একবার ব্যাবহারোপযোগী হলেও তারা জীবাণুমুক্ত করে একাধিকবার ব্যবহার করছেন বলে জানান ওই চিকিৎসক। তিনি বলেন, এখন ব্যক্তিগত খরচে এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তারা পিপিই সংগ্রহ শুরু করেছেন।

তবে পর্যাপ্ত সুরক্ষা উপকরণ না সরবরাহ করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পরিচালক মীর জামালউদ্দীন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত