ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

সু চিকে বিচারের কাঠগড়ায় নিয়েছেন যিনি

সু চিকে বিচারের কাঠগড়ায় নিয়েছেন যিনি
গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবাকার তাম্বাদুর

আজ রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার রায় দেবে হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। যার উদ্যোগে ওই আদালতে এই মামলাটি হয়েছে এবং যিনি মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চিকে আইসিজের কাঠগড়ায় দাঁড়ে করিয়েছেন তিনি আর কেউ নন, গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবাকার তাম্বাদুর।

ওই মামলার ওপর গত ১০-১১ তারিখে শুনানি হয় হেগের আদালতে। সেখানে দাঁড়িয়ে নিজের দেশ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগ প্রশ্নে বক্তব্য দিতে বাধ্য হয়েছেন সু চি। জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত বৃহস্পতিবার যখন ওই মামলায় আদেশ দিতে যাচ্ছে, তখন মিয়ানমারের নেত্রীকে আদালতে টেনে আনা ব্যক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছেন বিবিসি প্রতিনিধি অ্যানা হুলিগান। সেখানে তিনি এই মামলার প্রেক্ষাপট এবং গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী সম্পর্কে নানা তথ্য তুলে ধরেছেন।

কক্সবাজারে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শিবিরে আবুবাকার তাম্বাদুর সফরটি ছিল অপ্রত্যাশিত। যখন তিনি বেঁচে ফিরে আসা মানুষজনের কাহিনী শুনছিলেন, তখন মিয়ানমারের সীমান্তের অন্য পাশ থেকেও যেন তিনি গণহত্যার দুর্গন্ধ টের পাচ্ছিলেন।

তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমি উপলব্ধি করছিলাম টেলিভিশনের পর্দায় আমরা যা দেখি পরিস্থিতি আসলে তার চেয়েও কতটা গুরুতর। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক বাসিন্দারা সংগঠিত হামলা চালাচ্ছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, মায়ের কোল থেকে শিশুদের ছিনিয়ে নিয়ে জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে মারছে, পুরুষদের ধরে ধরে মেরে ফেলছে, মেয়েদের ধর্ষণ করছে এবং সবরকমের যৌন নির্যাতন করছে।’

রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা শুনতে শুনতে তাম্বাদুকের কেবল রুয়ান্ডার কথা মনে হচ্ছিলো। ১৯৯৪ সালে আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় পরিকল্পিত গণহত্যায় ৮ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়।

তিনি বলেন, রুয়ান্ডায় তুতসিদের ওপর যেরকম অপরাধ করা হয়েছিল, এটা সেরকমই মনে হচ্ছিল। এখানে সেই একই রকম কার্যক্রম হয়েছে, অমানবিক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে গণহত্যার সব বৈশিষ্ট্যই রয়েছে।

‘আমি বুঝতে পারলাম, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য এটা মিয়ানমারের সরকারের একটা চেষ্টা। সব মিলিয়ে এটা মানবিকতার একটা ব্যাপার।’

কথা বলার সময় তার কণ্ঠস্বর উঁচুতে উঠে যাচ্ছিল। ‘যা আমি শুনেছি আর দেখেছি, ব্যক্তিগতভাবে তাতে আমি ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। পেশাগতভাবে আমি চিন্তা করলাম, এসব কাজের জন্য মিয়ানমারকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। আর সেটা করার মাধ্যম হলো আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে একটি মামলা করা।’

জাতিসংঘের রোয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের সাবেক কৌঁসুলি কক্সবাজারের বাস্তুচ্যুত মানুষদের ক্যাম্পে বসে যা চিন্তা করছিলেন, তা হয়তো শুধুমাত্র কাকতালীয় কোন ঘটনা নয়, যেন সেটা ‘ঐশ্বরিক নিয়তি’ছিল।

গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। যে ১৪৯টি দেশ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, তাদের যেকোনো দেশ মামলা করতে পারে। কিন্তু সরাসরি তাম্বাদুর নির্দেশনায় গাম্বিয়া সেই পদক্ষেপ নিয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে গাম্বিয়া আবেদন করে যাতে আদালত একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি করে, যাতে আর কোন সহিংসতা বা ধ্বংসযজ্ঞ না ঘটে এবং রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক কাজের যে কোনও প্রমাণ সংরক্ষণ করা হয়।

মানবাধিকার সংগঠন গ্লোবাল সেন্টার ফর দি রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্টের প্রধান সাইমন অ্যাডামস বলছেন, কথিত নৃশংসতার দায়ে মিয়ানমারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করার জন্য শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিই সাহস, দক্ষতা এবং মানবতা দেখিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘অনেকে চীনাদের প্রতিশোধের ভয়ে ভীত। অন্যরা বলেছেন, এই কাজ করার জন্য এটা উপযুক্ত সময় নয়, রাজনৈতিকভাবে এটা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমি তার সাহস দেখে মুগ্ধ। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এর জন্য কতটা চাপ আসতে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা সামলাতে তিনি একটা কৌশল বেছে নিয়েছেন।’

আবুবাকার তাম্বাদু: খেলোয়াড় থেকে আইনজীবী

১৯৭২ সালে জন্ম নেয়া মিস্টার তাম্বাদু গাম্বিয়ার রাজধানী বানজুলে বড় হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন আঠারো ভাইবোনের মধ্যে একজন। তার বাবার তিনজন স্ত্রী ছিল।

তরুণ বয়সে তিনি খেলাধুলায় খুব ভালো করেন, ফুটবলে তার দেশের জন্য শিরোপা এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাবার ভয়ে তিনি খেলাধুলার স্বপ্ন বাদ দিয়ে দেন এবং একাডেমিক পথে হাঁটতে শুরু করেন।

৪৭ বছর বয়সী এই ব্যক্তি নিজেকে ‘ভাগ্যবান’বলে বর্ণনা করেন। কেননা তার মধ্যবিত্ত পরিবার দেশে একটি প্রাইভেট স্কুল এবং ব্রিটেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়াশোনার খরচ বহন করতে সমর্থ হয়েছিল। তিনি আইনের ওপর উচ্চশিক্ষা নেয়ার পর ব্রিটেন থেকে দেশে দেশে ফিরে আসেন এবং একজন সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে কাজ শুরু করেন।

ক্রমে রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠছিলেন তিনি। বুঝে নিচ্ছিলেন গাম্বিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এক পর্যায়ে তিনি ও তার বন্ধুরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন।

২০০০ সালে এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাম্মেহ'র কুখ্যাত নিরাপত্তা বাহিনী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করে, এতে ১৪জন শিক্ষার্থী, একজন সাংবাদিক এবং একজন রেডক্রস স্বেচ্ছাসেবী নিহত হন। এসময় তাম্বাদু দেখতে পান যে, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে এবং নির্যাতন করা হচ্ছে। তিনি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

কিন্তু তার পরিবার জাম্মেহর বিরোধিতা করার পরিণতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে এবং তাকে দেশের বাইরে কাজ করতে রাজি করায়। তখন তিনি আন্তর্জাতিক বিচারের ক্ষেত্রে কাজ করতে শুরু করেন।

এই স্বেচ্ছা নির্বাসন তাকে জাতিসংঘের সেই আদালতে কাজ করার সুযোগ এনে দেয় যেটি রোয়ান্ডা গণহত্যার কুশিলবদের বিচার করার জন্য স্থাপিত হয়েছিল। রোয়ান্ডা সেনাবাহিনীর সাবেক চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল অগাস্টাস বিজিমুনগুর বিচারে তাম্বাদুর ভূমিকা ছিল।

তিনি বিশ্বাস করেন, তিনি যা করছিলেন, সেটা শুধুমাত্র রোয়ান্ডার গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্যই নয়।

তার ভাষায়, ‘এটা ছিল আফ্রিকান সব নেতাদের প্রতি একটা বার্তা....আমি এটাকে দেখি আফ্রিকায় বিচার এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার একটি সংগ্রাম হিসাবে। এটা শুধুমাত্র রুয়ান্ডার ব্যাপার নয়।’

২০১৭ সালের শুরুতে জাম্মেহর পতনের পর তাম্বাদু গাম্বিয়ায় ফিরে আসেন এবং প্রেসিডেন্ট আদামা ব্যারোর মন্ত্রিসভায় কাজ করতে শুরু করেন।

বিচারমন্ত্রী হিসাবে যখন তিনি গাম্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে নিউইয়র্কে সফর করতে যান, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে যেতে না পারায় তাম্বাদুকে যাওয়ার অনুরোধ করেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান তাম্বাদু। যদিও এটা ছিলো একটা কাকতালীয় ঘটনা। আর বাংলাদেশে সফর করার পরই তিনি আইজিসিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আর এর মাধ্যমে দুনিয়ার কাছে একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে গাম্বিয়া।

এ নিয়ে তাম্বাদুর স্পষ্ট ঘোষণা, ‘আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা করার মাধ্যমে গাম্বিয়া দেখিয়ে দিয়েছে যে, নিপীড়নের নিন্দা করার জন্য সামরিক শক্তি বা অর্থনৈতিক শক্তির দরকার নেই। বড় বা ছোট সমস্ত রাষ্ট্রের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা এবং নৈতিক দায়িত্ব সমান।’

আর আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা করার কারণ হিসাবে তিনি বলেন, অঅমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতন চলছে আমরা সে ব্যাপারে বিশ্বব্যাপীকে কিছু করার তাগিদ দেয়া।

আর মামলা করার ফলে রোহিঙ্গাদের কিছুট জয় হয়েছে বলেও মনে করছেন তাম্বাদু।

তাই তো আজকের রায় সম্পর্কে তার বক্তব্য, ‘ফলাফল যাই হোক না কেন, আদালত অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিন বা না দিন, আমরা চেয়েছিলাম মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর কি ঘটছে, সে ব্যাপারে বিশ্ববাসী সজাগ হোক। আমি মনে করি মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ এখন জানে যে, বিশ্ববাসীর চোখ এখন তাদের ওপরে। তাই ফলাফল যাই হোক না কেন, এই মামলায় রোহিঙ্গাদের কিছুটা জয় হয়েছে।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত