ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

বিশ্বসূচকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান নিশ্চিতে উদ্যোগ প্রয়োজন

  ড. জান্নাতুল ফেরদৌস

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২২, ০১:৫১

বিশ্বসূচকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান নিশ্চিতে উদ্যোগ প্রয়োজন

একটা সময় দেশে হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সেসময় শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও এখনকার তুলনায় নেহাত কমই ছিল। তবে ছাত্র-শিক্ষক সবাই বিশেষ সম্মানের দাবিদার ছিলেন; এমনকি সরকারি কলেজগুলোতে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদেরও বিশেষ কদর ছিল।

যুগের পরিবর্তনের সাথে দেশে উচ্চশিক্ষার অধিক প্রসারের লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্বাধীনতার পর থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মান ক্রমশ অবনতি হয়েছে। তবে ঠিক কি কারণে এবং কিভাবে এ অবনতির ঘটনা ঘটেছে সেটি আমাদের অনেকের তেমন দৃষ্টিগোচর হয়নি। বরং ঢালাওভাবে আমরা এক্ষেত্রে অনেকসময় শিক্ষকদের আবার অনেকসময় শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করেতে দেখেছি।

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার পর সাধারণত একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে চার বছরের অনার্স ও এক বছরের মাস্টার্স কোর্স পড়ানো হচ্ছে। এছাড়াও কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল ও পিএইচডি গবেষণার সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে কলেজগুলোতেও চার বছরের অনার্স কোর্স এবং এক বছরের মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রায় দুই হাজার কলেজ, অর্ধশতাধিক সরকারি (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয় এবং শতাধিক বেসরকারি (প্রাইভেট) বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা দেয়া হচ্ছে।

কিন্তু এতসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম চলমান থাকলেও বিশ্বসূচকে আমাদের অবস্থান এমনকি এশিয়া অঞ্চলেও এই অবস্থান সন্তোষজনক নয়। যেটি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমরা নানা অভিযোগ এবং ত্রুটির বিষয়কে সামনে নিয়ে আসি। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং এর মান নিশ্চিতে আমরা কমবেশি সবাই সোচ্চার। এতে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অথচ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো কি কি সেটা খুঁজে বের করাও গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতেই মান নিশ্চিত সম্ভব নয়, বরং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু বিশেষ অংশে উন্নয়ন করা জরুরি।

বেশিরভাগ সময়ে আমরা লক্ষ্য করে থাকি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাসরুমে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত সামঞ্জস্য নয়। আমরা জানি ক্লাসরুমে ছাত্র-শিক্ষকের আদর্শ অনুপাত ১:৩০ থাকা উচিত, কিন্তু আমাদের শ্রেণীকক্ষে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী থাকার জন্য শিক্ষকদের পক্ষে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের প্রতি আলাদা করে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সাফল্যের অন্যতম শক্তিশালী মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আরেকটি দিক হল, আমাদের দেশে অন্যান্য অনেক পেশার তুলনায় শিক্ষকদের বেতন ভাতা অপ্রতুল। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের সাথে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অনেক কম বেতন এবং সীমিত সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন। যা শিক্ষার মানউন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা তাদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না দেখে হতাশ এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের তাগিদে শিক্ষা বিমুখ।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য হল গবেষণা এবং নতুন জ্ঞান তৈরি। কিন্তু উচ্চ শিক্ষায় গবেষণার জন্য আমাদের দেশে বরাবরই তহবিলের অভাব দেখা যায়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ খুবই সীমিত। সামগ্রিক চিত্রে দেখা যায়, কিছু সংখ্যক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের মোট বাজেটের আনুমানিক ১% ব্যয় করেছে গবেষণায়, অন্যদিকে কিছু সংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ক্ষেত্রে ব্যয় করেছে তাদের মোট বাজেটের আনুমানিক ২% এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য বরাদ্ধ খুবই নগণ্য।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যেসকল শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা অগ্রগতি এবং সুনাম অর্জনের কথা চিন্তা করি, বেশিরভাগ সময়ে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের পছন্দের বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে অসমর্থ হয়। অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা নিজের পছন্দের বিষয়ে পড়াশুনা করতে চেয়েও শুধুমাত্র পিতা-মাতার সমর্থনের অভাবে সেই বিষয়ে পড়তে পারে না। এমনকি, শিক্ষা জীবনে পিতা-মাতার উৎসাহের অভাবে একজন শিক্ষার্থী আশানুরূপ ফলাফল করতে ব্যর্থ হয়।

সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জন এবং উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতের জন্য পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো আবাসন ব্যবস্থা নেই, আবার অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে তা নিয়েও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। একটি সিটের বিপরীতে একাধিক ছাত্রকে থাকতে হচ্ছে, খাবারের মান নিম্মমানের, থাকার পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন, এবং হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতির প্রভাব। যেটি আমাদের সমগ্র উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রভাব ফেলছে।

টিএইচই ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ের সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২২ সালের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালটেক, হার্ভার্ড ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ১৮৩, জাপানের ১১৮, যুক্তরাজ্যের ১০১, চীনের ৯৭, ভারতের ৭১, স্পেনের ৫২, জার্মানির ৫০, অস্ট্রেলিয়ার ৩৭, দক্ষিণ কোরিয়ার ৩৬, কানাডার ৩২, মালয়েশিয়ার ২১, পাকিস্তানের ২১টিসহ বিশ্বের ৯৯টি দেশের মোট ১৬৬২টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে।

যদিও বাংলাদেশ থেকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এ র‌্যাংকিংয়ে রয়েছে, যাদের বৈশ্বিক অবস্থান যথাক্রমে ৮০১-১০০০, ১০০১-১২০০ এবং ১২০১+এর মধ্যে। টিএইচই উপরোক্ত ১৩ নির্দেশকের স্কোরে সামান্য পুনর্বিন্যাস করে এশিয়া র‌্যাংকিং প্রকাশ করছে। ২০২১ সালের র‌্যাংকিংয়ে এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাবি ও বুয়েটের অবস্থান যথাক্রমে ৩০১-৪০০ এবং ৪০০+এর মধ্যে।

যুক্তরাজ্য ভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কিউএস রেপুটেশন সার্ভে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কোপাস থেকে তথ্যাদি নিয়ে ছয়টি নির্দেশক যথা-একাডেমিক রেপুটেশন (৪০ শতাংশ), এমপ্লয়ার রেপুটেশন (১০ শতাংশ), শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত (২০ শতাংশ), সাইটেশন (২০ শতাংশ), বিদেশি শিক্ষকের অনুপাত (৫ শতাংশ) এবং বিদেশি শিক্ষার্থীর অনুপাত (৫ শতাংশ) বিবেচনায় নিয়ে প্রাপ্ত স্কোরের ভিত্তিতে র‌্যাংকিং করে থাকে।

২০২২ সালের কিউএস বৈশ্বিক র‌্যাংকিং তালিকার শীর্ষ পাঁচে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ র‌্যাংকিং তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ১৭৭, যুক্তরাজ্যের ৯০, চীনের ৫৮, জাপানের ৪৮, জার্মানির ৪৬, অস্ট্রেলিয়ার ৩৮, ভারতের ৩৪, মালয়েশিয়ার ২২, পাকিস্তানের ১১, বাংলাদেশের চারটিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোট ১৩০০টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। এ র‌্যাংকিংয়ে ঢাবি ও বুয়েটের বৈশ্বিক অবস্থান ৮০১-১০০০, এবং ব্র্যাক ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১০০১-১২০০-এর মধ্যে।

তবে এই সূচকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান না থাকায় ইতোমধ্যে দেশব্যাপী সমালোচনা তৈরি হয়েছে। বিশেষ ব্যক্তিবর্গ ঐ তালিকায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম না থাকায় নিদারুণ আপসোস প্রকাশ করেছেন।

তবে বস্তত ঠিক কি কারণে বিভিন্ন সূচকে আমাদের নাম আসে না! কিংবা স্বনামধন্য সূচকগুলোতে নাম আসার জন্য যে পরিমাণ কর্মপদ্ধতি, গবেষণা, বরাদ্দ, এবং পরিবেশের প্রয়োজন হয় সেটি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি কিনা এ বিষয়টি নিয়ে খুব স্বল্প পরিমাণে আমরা কথা বলি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে চোখ বুলাতেই আমরা দেখি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ছাত্র শিক্ষক রাজনীতির খবর। কিন্তু আদতে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সাথে দেশীয় চিন্তাচেতনা, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দক্ষতা এবং সমপরিমাণ ইচ্ছাশক্তি আমাদের কতটুকু আছে এটি প্রশ্ন রেখে যায়।

একইসাথে বাংলাদেশের জন্য দরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বেসিক পলিসি প্রণয়ন। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি সম্পন্ন করে বেসিক পলিসি প্রণয়ন সম্ভব নয়। বরং নিয়োগ এবং পদোন্নতিতে ক্রাইটেরিয়া পরিবর্তন করা জরুরী। বিভিন্ন এডুকেশনাল পদে এবং ভিসি-প্রোভিসিসহ প্রশাসনিক পদে ভালো এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ডদের নিয়োগ দিতে হবে। একইসাথে গবেষণার ফান্ডিং করা উচিত প্রপোজাল ও গবেষকের ট্র্যাক রেকর্ড দেখে। তাহলে পরিবর্তনের আশা করা যেতে পারে।

এ ছাড়া বিদেশি ও পিএইচডি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত কমানো, বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ, বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের উদ্যোগ নেওয়াও প্রয়োজন। এতে করে অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ থেকেও একটি সম্মানজনক সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ে স্থান করে নেবে এবং বিশ্বের শীর্ষ পাঁচশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় যোগ হবে বাংলাদেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ জার্নাল/কেএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত