ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩১ মিনিট আগে
শিরোনাম

‘বিছিন্নভাবে জাতীয়করণ, বৈষম্য আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে’

  মো. মহসিন মিয়া

প্রকাশ : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:১২  
আপডেট :
 ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৩১

‘বিছিন্নভাবে জাতীয়করণ,  বৈষম্য আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে’

বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা জাতীয়করণ বর্তমানে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্তমান সরকার যে সকল উপজেলায় কোন সরকারি স্কুল, কলেজ নেই সে সকল উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ করছে। নিঃসন্দেহে যে সকল প্রতিষ্ঠানগুলো জাতিয়করণের অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে সে সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কমর্চারীদের আনন্দের আর সীমা নাই। আনন্দ র‌্যালী, আনন্দ মিছিল, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ আরো কতো কি! কিন্তু কোন কোন প্রতিষ্ঠানগুলো জাতিয়করণ করা হচ্ছে? উপজেলা সদরে অবস্থিত অধিকাংশ নামি দামি প্রতিষ্ঠানগুলোই নির্বাচন করা হয়েছে। যে সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর আছে কোটি টাকার তহবিল ও লাখ লাখ টাকা প্রতি মাসে আয়। আরো আছে স্থাবর অস্থাবর অগাধ সম্পত্তি!

কিন্তু এসকল প্রতিষ্ঠানগুলো বড় মাপের ও শিক্ষকেরা শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠান থেকে মান সম্মত বেতন ভাতাদি পেয়ে আসছেন। এমনও উদাহরণ পাওয়া যাবে যে, সে সকল প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু শিক্ষক সরকারি সব মিলিয়ে শিক্ষকদের চেয়েও বেশি বেতন পেতেন। অন্যদিকে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে দেখা মিলবে যে, সেখানে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থেকেই শিক্ষকদেরকে কোন বেতন ভাতাদি দেয়া হয় না। আবার যেগুলো থেকে দেয়া হয় তা-ও আবার যৎসামান্য। তাহলে যে প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পশালী ছিল ও যে সকল শিক্ষকেরা সম্মানজনক বেতন পেতেন সে সকল শিক্ষকেরাই আরো বেশি সুবিধার অধিকারী হচ্ছেন! আর যারা মাসের বিশ তারিখ আসলেই বেতনের আশায় দিন গুণতে থাকতেন তারা শুধু দিন গুণতেই থাকবেন।তার মানে তেলের মাথায় তেল শুকনো মাথায় বেল।

বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় গড়ে কলেজ আছে ৮টি অন্যদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংখ্যা গড়ে ৩৯.৪২টি (তথ্য সূত্র ব্যানবেইস-২১০৬)।তার মানে স্কুল ও কলেজের অনুপাত প্রায় ৫:১।কিন্তু জাতিয়করণ করা হচ্ছে সমান সমান। একটি মধ্যমানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যতজন শিক্ষক-কর্মচারি থাকে একটি কলেজে তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ থাকে।সবাই এতদিন ছিলেন বেসরকারি।এখন তাদের মধ্য হতে কেউ সরকারি আবার কেউ বেসরকারি! এখানে আরো প্রতিয়মান যে, প্রতিটি উপজেলায় ৪০টির মধ্যে একটি স্কুল এবং কলেজের ক্ষেত্রে ৮টির মধ্যে একটি জাতীয়করণ করা হচ্ছে। এখানে আরেকটি বৈষম্যের সৃষ্টি হয় নয় কি? আবার শিক্ষকের সংখ্যাও বেশি। একই দেশে বাস করে একই শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করে, একই সিলেবাসের পড়া পড়িয়ে, একই বাজার থেকে কেনাকাটা করে, সমপরিমান পরিশ্রম করে এতদিন কেউ পেতেন পুরো হাঁসটা আবার কেউ পেতেন শুধু ডিমটা। আরা যারা অঘোষিত হাঁসটাই পেতেন তারাও এখন পুরো হাসটা পাবার স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছেন!

একটি পরিবারে পাঁচ ভাই থাকলে সম্পদশালী ও বিত্তশালী ভাইটি সংসার থেকে চলে গেলে সে সংসারের যে অবস্থা হয়, এখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিদ্যালয়গুলোরও সে দশা হতে যাচ্ছে। সরকার থেকে কিছু পাবার আন্দোলনের প্রতিবেশীকে এখন বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো হারাতে বসছে।

মুখে মুখেই শোনা যায় যে, বর্তমান সরকার গরীবদের দিকে বেশি খেয়াল রাখছে। তাহলে গরীব প্রতিষ্ঠান গুলোর দিকে খেয়াল না রেখে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানগুলোর ‍দিকে খেয়াল রেখে সে ঐতিহ্য হারাচ্ছে না তো?

প্রত্যন্ত গ্রামের সে স্কুলগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে ৮০% এর চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আসে অতি দরিদ্র পরিবার থেকে।সেখানে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৬০-৭০ শিক্ষার্থীই বিদ্যালয়ের কোনো পাওনাদি পরিশোধ করতে পারে না।বাকিগুলোর মধ্যে আরো আছে সরকারি বৃত্তি প্রাপ্ত ও উপবৃত্তি প্রাপ্ত। সব মিলে গ্রামাঞ্চলের ২০% শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পাওনাদি পরিশোধ করে থাকে।এ আয় থেকেই বিদ্যালয়ে আসবাব প্রত্র নির্মাণ, মেরামত, সংস্কার, বিভিন্ন জাতিয় দিবস পালন করা হয়ে থাকে। বিদ্যালয় বেসরকারি হলেও সরকারের সকল আদেশ বিদ্যালয়ের আয় থেকে মিটাতে হয়। সরকার বিদ্যালয়গুলো দিবস পালনের কোন রকম খরচ দেয় না। সর্ব দিকে তাকালেই দেখা যাবে যে, গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা শোচনীয় জীবন যাপন করতে হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার সিংহভাগই অবদান রাখছে গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলো।

অভাব অনটনের একটি পরিবারে কয়েকজন সদস্য থাকলে একজন সদস্যকে বাড়তি সুযোগের সৃষ্টি করে দেয়া যেমনি সমতা নয়, তেমনি কোন পরিবারের জন্যও মঙ্গলজনক নয়। এতে করে পরিবারের সদস্যদের চেয়ে পরিবারের কর্তারেই বেশি কষ্ট লাগার কথা। আর সে কষ্ট লাঘব করতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি সমতার সৃষ্টি করবেন বলে পরিবারের অন্য সদস্যরা অধীর আগ্রহে বসে থাকেন।আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। খেলে সবাই এক সাথেই খাবো, উপবাস থাকলেও সবাই একসাথেই থাকবো, সেটি হচ্ছে অঙ্গীকার হওয়া উচিত। একই সাথে এতদিন থেকে এখন কেউ পেট পুরে খাবে আর কেউ অর্ধাহারে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে তা হতে পারে না।

শিক্ষকেরা সকল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবীতে দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন করে আসছে। অথচ তাদের মধ্য থেকেই কয়েকটি জাতিয়করণ করে তাদের আন্দোলনের এক হাত ভেঙে তাদেরকে দূর্বল করে দিচ্ছে।

পরিশেষে বলতে চাই যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণের দাবি কোন করুনা করার দাবি নয় সেটি শিক্ষকদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সাংবিধানিক সমাতার দাবি। সে ন্যায্য ও সমতার দাবী মেনে নেয়ার জন্য শিক্ষকেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

লেখক: শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • পঠিত