ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

বিদ্যালয়ের কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দুই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে

  হিমেল চাকমা, রাঙামাটি থেকে

প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৫৯

বিদ্যালয়ের কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দুই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে
রুমা উপজাতীয় আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়। ছবি: সংগৃহীত

আবাসিক শিক্ষার্থীদের ইউনিফরম, বই খাতা কিনা না হলেও কিনা হয়েছে! শিক্ষা সফরে নেয়া না হলেও শিক্ষা সফর হয়েছে! বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা না হলেও প্রতিযোগীতা হয়েছে! পুকুর সংস্কার না হলেও সংস্কার হয়েছে! জঙ্গল কাটা না হলেও জঙ্গল কাটা হয়েছে! মাঠ সংস্কার না হলেও সংস্কার হয়েছে! এ ধরণের অর্ধ শতাধিক খাত বানিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎতের অভিযোগ উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে পরিচালিত বান্দরবানের রুমা উপজাতীয় আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় মিত্র এবং রাঙামাটির রাজস্থলী উপজাতীয় আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. দুলাল হোসেনের বিরুদ্ধে।

অভিযুক্ত দুজনকে স্ব-স্ব বিদ্যালয় থেকে প্রত্যাহার করে বোর্ডের প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯-২০২১ অর্থ বছরে বান্দরবানের রুমা উপজাতীয় আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় মিত্রের বিরুদ্ধে ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৭২ টাকার দুর্নীতির সত্যতা পায় উন্নয়ন বোর্ড।

সত্যতা পেয়ে বোর্ডের প্রকল্প পরিচালক ইফতেখার আহমেদের স্বাক্ষরিত এক আদেশে বিদ্যালয় থেকে প্রত্যাহার করে চলতি বছর ১৯ এপ্রিল সঞ্জয় মিত্রকে বোর্ডের প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়।

আত্মসাৎ করা অর্থগুলো থেকে গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন শিবলীর মাধ্যমে ২ লাখ ৩৩ হাজার ২শ ৫০ টাকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লাভলু ত্রিপুরার কাছে ফেরত দেয় সঞ্জয় মিত্র। ইউএনও মোহাম্মদ মামুন শিবলী ও শিক্ষক লাভলু ত্রিপুরা বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেন।

বাকী ৯ লাখ ১১ হাজার ৫২২ টাকা চলতি বছর গত মে মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়ার আদেশ দিয়ে সঞ্জয় মিত্রকে চলতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় সাপ্তাহে চিঠি দেন প্রকল্প পরিচালক। কিন্তু এ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো বুঝিয়ে দিতে পারেনি সঞ্জয় মিত্র।

বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট একাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব দুর্নীতি ছাড়াও বিদ্যালয়ের পুরনো সরঞ্জাম বিক্রি, প্রতি বছর বিদ্যালয় আশপাশে নারিকেল বাগানের নারিকেল ও ডাব বিক্রির টাকাও নিজের পকেটে ভরে সঞ্জয় মিত্র। এছাড়া ভর্তি মৌসুমে করেন ভর্তি বাণিজ্য।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সঞ্জয় মিত্র বলেন, স্কুলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আপনি জানার কে? আমার হিসাবের কোন গড়মিল হয়নি। হিসাবে গড়মিল না হলে আপনাকে স্কুল থেকে প্রত্যাহার করে প্রধান কার্যালয়ে আনা হল কেন জানতে চাইলে কল কেটে দেন সঞ্জয় মিত্র।

১৯৮৮ সালে স্থাপিত হয় রুমা উপজাতীয় আবাসিক বিদ্যালয়টি। ২০২০ সালে সঞ্জয় মিত্রকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় উন্নয়ন বোর্ড।

এদিকে ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০, ২০২০-২১ অর্থ বছরে রাজস্থলী উপজাতীয় আবাসিক উচ্চ বিদ্যালের প্রধান শিক্ষক দুলাল হোসেনের বিরুদ্ধে ৫১ লাখ ১৫ হাজার ৮৪৩ টাকার অস্বাভাবিক ব্যয়ের হিসাব পেয়েছে উন্নয়ন বোর্ড। গত অর্থ বছরেও বোর্ডের কাছে সন্দেহজনক বার্ষিক ব্যয় হিসাব জমা দিয়েছেন। এ হিসাবের অসংগতি থাকায় গত ১৭ আগস্ট মো. দুলাল হোসেনকে বিদ্যালয় থেকে প্রত্যাহার করে তদন্ত শুরু করে বোর্ড।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রত্যক অর্থ বছরে বোর্ড কর্তৃক পরিচালত ৪টি বিদ্যালয়ের অনুকুলে বরাদ্দ দেয় উন্নয়ন বোর্ড। বছর শেষে অব্যয়িত অর্থ ফেরত দেয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রতি বছরের ন্যায় ২০২১-২২ অর্থ বছরেও বিদ্যালয়গুলো বোর্ডকে অব্যয়িত অর্থ ফেরত দিলেও রাজস্থলী উপজাতীয় আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফেরত দেয় অত্যন্ত কম। বিভিন্ন খাতে খরচ দেখিয়েছেন। খাতের বিপরীতে দেয়া বরাদ্দের টাকাগুলো অন্য খাতে স্থানান্তর করে ব্যয় করেছেন দুলাল।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, শুধু ২০২১-২১ অর্থ বছরে রাজস্থলী আবাসিক বিদ্যালয়কে আবর্তক ব্যয়ের জন্য ৮টি খাতের বিপরীতে ২ কোটি ৫০ লাখ ৮১ হাজার বরাদ্দ দেয় উন্নয়ন বোর্ড। এ টাকা থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ ২৮ হাজার ৯১৫ টাকা ব্যয় দেখিয়ে ব্যয় বিবরণী বোর্ডে জমা দেন দুলাল। বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী এসব খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ স্ব-স্ব খাতে ব্যয় করতে হবে। ব্যয় না হলে অর্থ বোর্ডে ফেরত যাবে। এ খাতের টাকাগুলো অন্য খাতে রুপান্তরিক করে ব্যয় করা যাবে না।

কিন্তু বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দুলাল হোসেন তা অনুসরণ না করে বিবিধ খাতের ১০ লাখ ১২ হাজার টাকার বিপরীতে ৩০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা বিবিধ ব্যয় দেখিয়েছেন। এসব গড়মিল হিসাব দেখে যেন কপালে চোখ উঠে উন্নয়ন বোর্ডের অডিট কর্মকর্তাদের।

অভিযোগের বিষয়ে দুলাল হোসেন বলেন, আমি অসুস্থ মানুষ। শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। বোর্ডকে আমি যে ব্যয় হিসাব জমা দিয়েছি তা ভুল হয়েছে। ভুল হবার কারণ আমি তখন অসুস্থ ছিলাম। হিসাব জমা দেয়ার পর বুঝতে পেরেছি ১৪ লাখ টাকা ব্যাংকে পড়ে আছে। সে টাকাগুলো আমি আত্মসাৎ করিনি। এখন আমার চাকরি চলে গেলে কোথাও চাকরি পাব না। দুলাল বলেন, বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সাথে সভা করে এক খাতের টাকা অন্য খাতে স্থানান্তর করা হয়েছে। বলেন, আমি অসুস্থ। আমার মানবিক দিকটা একটু দেখবেন।

বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট একাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুলাল হোসেন এ দুর্নীতি ছাড়াও ভর্তি মৌসুমে করেন ভর্তি বাণিজ্য করেন।

রাজস্থলি আবাসিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ১৯৯৩ সালে। ২০১৫ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় দুলাল হোসেনকে।

অভিযুক্ত শিক্ষকদের ব্যাপারে বোর্ডের টেকসই সমাজিক সেবা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ইফতেখার আহমদ বলেন, হিসাব বিশ্লেষণে যেটা পেয়েছি তা হল বিদ্যালয়গুলোতে কিছু দুর্নীতি হয়েছে সেটা ঠিক। সুষ্ঠু তদন্তের সাথে দুই বিদ্যালয়ের দুই প্রধান শিক্ষক ও এক সহকারী শিক্ষককে বোর্ডের প্রধান কার্যালয়ে আনা হয়েছে। যে অভিযোগ পাওয়া গেছে তা আমরা শিক্ষকদের কাছ থেকে আশা করতে পারি না। তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ছেলে মেয়েদের শিক্ষার আওতায় আনতে রাঙামাটিতে দুটি এবং বান্দরবানে তিনটি আবাসিক বিদ্যালয় নির্মাণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। বিদ্যালয়গুলো হল বান্দরবানে ম্রো আবাসিক বিদ্যালয়, রুমা উপজাতীয় আবাসিক বিদ্যালয়, আলীকদম উপজাতীয় আসাবিক বিদ্যালয়, রাজস্থলী উপজাতীয় আবাসিক বিদ্যালয়।

বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত