ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩২ মিনিট আগে
শিরোনাম

সুন্দরবনে হুমকির মুখে হরিণের অস্তিত্ব

  বাগেরহাট প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ২২:১২

সুন্দরবনে হুমকির মুখে হরিণের অস্তিত্ব

পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ মায়াবী চিত্রল হরিণের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। থেমে নেই চােরা শিকারী ও পাচারকারীদের অপতৎপরতা। চােরা শিকারীদের কবলে পড়ে মারা পড়েছে অসংখ্য হরিণ।

বন বিভাগসহ আইন-শৃখলা বাহিনী সুন্দরবনের সম্পদ ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় তৎপর থাকলেও ওই চক্রটি বিভিন্ন কৌশলে হরিণ শিকার করে প্রশাসনের চােখ ফাঁকি দিয়ে মাংস, চামড়া, মাথা পাচার করছে। মাঝে মধ্যে বন বিভাগ, কােস্টগার্ড বা পুলিশের হাতে পাচারের সময় ধরাও পড়ছে।

গত প্রায় দেড় বছরে পূর্ব সুদরবন ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় বন বিভাগ, কােস্টগার্ড, পুলিশ ১৩টি অভিযানে প্রায় ৫শ ১০ কেজি হরিণর মাংস, ৩টি চামড়া, ৬ টি মাথা, ৮টি নৌকাসহ বিপুল পরিমাণ হরিণ শিকারের ফাঁদ জব্দ করেছে। এ সময় হরিণ শিকার ও পাচারের অভিযােগে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিক আটক করা হয়েছে।

১৯৯৫ সালের এফএও এবং ইউএনডিসি’র কারিগরি সহযােগিতায় পরিচালিত পশু শুমারী অনুযায়ী সুদরবন হরিণের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার। ১৯৯৬-৯৭ সালর ইটিগ্রটড রিসার্স ম্যানজমট প্রকল্পের আওতায় বন্য প্রানীর উপর এক জরিপ হরিণের সংখ্যা ছিল এক লাখ থেকে দেড় লাখ। ২০০১ সালের আরেক জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল একই।

সুদরবনর আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার শিকারীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সব সময় সতর্ক থাকলেও চােরা শিকারীদের বুলেটবিদ্ধ, মাছ বা কাঁকড়ার পাস করে বনে ঢুকে জাল পেতে স্প্রি বসানাে ফাঁদ, বিষটােপ, কলার মধ্যে বরশি ঝুলিয় রাখা এবং চেতনা নাশক ঔষধ দিয়ে নিধন করা হয়ে থাকে বিপুল সংখ্যক হরিণ। শিকারীদের শিকার করা হরিণর মাংস, চামড়া পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়, শহরের এক শ্রেণির উচ্চ বিলাসী মানুষ ও সমাজপতিদের বাসায়। আবার হরিণের ২/৪ কেজি মাংস দিয়ে করা হয়েছে নানা কাজের তদবীর। কেজি প্রতি এ মাংস ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। হরিণের চামড়ারও কদর রয়েছে যথেষ্ঠ। একটি চামড়া ৫/৭ হাজার টাকা বিক্রি হয়ে থাকে বলে সূত্র জানায়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পূর্ব সুন্দরবনের পশুর নদীর চিলা এলাকা থেকে গত ৭ জানুয়ারি বনরক্ষীরা অভিযান চালিয়ে ৩০ কেজি হরিণের মাংস ও পাঁচারকারীদের ফেলে যাওয়া একটি নৌকা উদ্ধার করে। এ সময় পাঁচারকারীরা পালিয় যায়। গত ৩ জানুয়ারি শরণখােলা রেঞ্জের চরখালী টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা চরখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৪শ ফুট হরিণ ধরার ফাঁদ জব্দ করে। এ সময় শিকারীরা গহীন বনে পালিয় যায়। গত ৯ ডিসম্বর সন্ধ্যায় একই এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২০ কেজি হরিণের মাংস ও ১টি নৌকা এবং ৮ ডিসেম্বর দুপুর শরণখাপলা রেঞ্জের শাপলা টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা সিদুরবাড়িয়া এলাকায় অভিযান চালিয় পরিত্যাক্ত অবস্থায় ১০ কেজি হরিণের মাংস ও ১টি নৌকা উদ্ধার করে।

গত ২২ নভেম্বর রাতে ও ২৩ নভেম্বর বন বিভাগের স্মার্ট টহল টিম বিভিন্ন এলাকা থেকে দুবলার চরের রাস মেলায় আসা ৫৭ জনকে হরিণ শিকার করার অভিযােগ আটক করে। এদের দুটি ট্রলারর তল্লাশি চালিয়ে হরিণের মাথা, চামড়া, ৫০ মিটার হরিণ শিকার করার ফাঁদ উদ্ধার করে। তাদের বিরুদ্ধ বন আইন মামলা করা হয়েছে।

কােস্টগার্ড পশ্চিম জােনর হারবাড়িয়া টহল দল গত ১১ নভেম্বর বন সংলগ মিরগামারি খাল সংলগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ কেজি হরিণের মাংস, একটি চামড়া, একটি মাথা উদ্ধার করে চাঁদপাই ফরেস্ট অফিস হস্তান্তর করে। গত ৮ জুন ভােরে সুন্দরবন সংলগ হরিণ শিকরী ও পাঁচারকারী হিসাব পরিচিত চরদুয়ানী এলাকার বলেশ্বর নদীর শাখা নাপিতখালী খাল থেকে শরণখাপলা রেঞ্জের সুপতি কােস্টগার্ড অভিযান চালিয়ে ২৪০ কেজি হরিণের মাংস, একটি নৌকা উদ্ধার করে। এ সময় পাঁচারকারীরা পালিয় যায়।

গত ১২ মে সন্ধ্যায় ও গভীর রাতে সুন্দরবনের শরণখােলা রেঞ্জের স্মার্ট টিমের টহল ও জ্ঞানপাড়া টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা শেলার চরের মানিকখালী খাল ও চরদুয়ানীর বলেশ্বর নদীতে অভিযান চালিয়ে হরিণ শিকার ব্যবহৃত এম.বি আল-মদিনা-১ নামের একটি কার্গাে জাহাজ, ৩০ কেজি হরিণের মাংস, ২৩০টি হরিণ ধরার ফাঁদ ও ১টি নৌকা জব্দ করে। এ সময় হরিণ শিকারের দায়ে দাকােপ উপজেলার আমতলা গ্রামের বিশ্বজিৎ মৃধা, বাউফল উপজেলার দাসপাড়া গ্রামের আল-আমিন, গলাচিপা উপজেলার চরকাজল গ্রামের মাঃ হাসান, একই গ্রামের মাঃ সুমন, আসাশুনি উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের সাইদ সরকারের বিরুদ্ধে বন বিভাগীয় মামলা হয়েছে।

কােস্টগার্ড পশ্চিম জােনর অপারেশন কর্মকর্তা ল. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় কােস্টগার্ডর ৫টি স্টেশনের কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দ তাদের আওতাধীন এলাকাসমূহ আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রনে ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় প্রতিনিয়ত তাদের টহল অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে শিকারী চক্র হরিণ শিকার করলেও শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। চােরা শিকারী ও পাচারকারীরা মাছের পাস নিয়ে বনে ঢুকে হরিণসহ বন্যপ্রাণী শিকার করে। তাই হরিণ শিকার প্রতিরােধে চােরা শিকারীদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের পাস বন্ধ করে দিয়েছে বন বিভাগ।

তিনি বলেন, এব্যাপারে স্থানীয় এলাকাবাসী অসচেতন। যার কারণে অভিযানকালে হরিণ শিকারী ও পাচারকারীরা মাংস, চামড়া ও মাথা রেখে পালিয়ে যায়। আমাদর পক্ষ থেকে ক্যাম্পেইং এর মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বন্যপ্রাণী রক্ষায় জনসাধারণকে বিভিন্ন ভাবে অবহিত করা হয়। সুদরবনের সম্পদ রক্ষাসহ আইনী বিষয়গুলাে বাস্তবায়নের ভূমিকায় রয়েছে বন বিভাগ। আমরা তাদের সহায়তা করছি মাত্র।

সুদরবন পূর্ব বিভাগর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, সুদরবনের হরিণ শিকার ও পাচার রােধে কঠাের নজরদারি রয়েছে। শিকারী ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বন বিভাগের দায়ের করা মামলায় সম্প্রতি দুইজন হরিণ শিকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। হরিণ সহ বন্যপ্রাণি ও বনজ সম্পদ রক্ষায় বনরক্ষীদের পাশাপাশি বন বিভাগর ৪টি স্মার্ট টিম পর্যায়ক্রমে পূর্ব সুদরবন কাজ করছে। হরিণ শিকারের ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে। সুন্দরবন বিশাল এলাকা তাই হরিণ শিকার রােধ সর্ব মহলের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে তিনি বলেন।

বাংলাদেশ জার্নাল/জেডআই

  • সর্বশেষ
  • পঠিত