ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

ফিরতে রাজি নয় কেউ

ফের ব্যর্থ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০১৯, ০০:০৪

ফের ব্যর্থ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি নিয়ে চীন ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে দীর্ঘ সময় আলোচনা চালানোর পরও রোহিঙ্গারা ফিরতে আগ্রহী না হওয়ায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। এদিকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত না যাওয়ার জন্য যারা প্ররোচনা দিয়েছে— বিশেষত যেসব এনজিও প্রত্যাবাসনবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।

বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বৃহস্পতিবার বলেন, আমাদের দিক থেকে তো আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকায় থাকা ১০৩৭টি পরিবারের মোট ৩৫৪০ জনের সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কেউ এখনো স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি হননি।

এ পর্যন্ত ৩৩৯টি পরিবারের একজন করে প্রতিনিধির সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়া চলবে। কেউ স্বেচ্ছায় রাজি হলে তাকে ফেরত পাঠাতে আমরা প্রস্তুত। ওই সময়ের আগে আমরা বলতে পারব না যে প্রত্যাবাসন হচ্ছে না।

রাখাইনের গ্রামে গ্রামে হত্যা-ধর্ষণ আর ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যে প্রাণ হাতে পালিয়ে আসা এই রোহিঙ্গারা ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তত চারটি শর্তের কথা বলছেন। তাদের দাবি, প্রত্যাবাসনের জন্য আগে তাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। জমিজমা ও ভিটেমাটির দখল ফেরত দিতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাখাইনে তাদের সঙ্গে যা হয়েছে, সে জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

এর আগে গতবছর ১৫ নভেম্বর একইভাবে প্রত্যাবাসন শুরুর সব প্রস্তুতি নিয়ে দিনভর অপেক্ষা করার পরও মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে রোহিঙ্গাদের মনে আস্থা তৈরি না হওয়ায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়।

এবার মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা হলেও দুই বছর ধরে চলা এ সংকট সমাধানের দ্বিতীয় দফা চেষ্টাও দৃশ্যত ব্যর্থ হলো।

অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে মোমেন হাল ছাড়তে রাজি নন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি। সমস্যা মিয়ানমারের, সমাধানও তাদেরই করতে হবে। আমরা জোর করে কিছু করব না।

নিজেদের দেশে ফিরে যেতে রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের বিষয়টিকে দুঃখজনক হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, আমরা চেয়েছি আজ থেকে প্রক্রিয়াটা শুরু হোক। এরপরও আমরা প্রক্রিয়াটা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করব।

আবদুল মোমেন বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত না যাওয়ার জন্য যারা প্ররোচনা দিয়েছে, যারা ইংরেজিতে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড লিখে সাপ্লাই দিয়েছে এবং যেসব এনজিও না যাওয়ার জন্য তাদের আহ্বান জানিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে আসতে থাকে রোহিঙ্গারা, এই সংখ্যা কিছু দিনের মধ্যে সাত লাখ ছাড়ায়। আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। তাদের কক্সবাজারের কয়েকটি কেন্দ্রে আশ্রয় দিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় জরুরি মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার।

আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও নানা কারণে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত গতবছর ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসন শুরুর তারিখ ঠিক হলেও নতুন করে নিপীড়নের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা থেকে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।

এরপর দুই সরকারের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পাঠানো তালিকা থেকে ৩ হাজার ৪৫০ জনকে রাখাইনের অধিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের ফেরত নিতে রাজি হওয়ার কথা জানায় মিয়ানমার।

প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক হওয়ার পর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ করে তালিকায় থাকা শরণার্থীদের কক্সবাজারের ২৪, ২৬ ও ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রেখে টেকনাফের শালবাগান এলাকার ২৬ নম্বর ক্যাম্পে শুরু হয় সাক্ষাৎকার। ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশ যৌথভাবে এই রোহিঙ্গাদের কাছে জানতে চায়, তারা ফিরতে ইচ্ছুক কি না?

পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার জন্য মিয়ানমারের দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ও চীনা দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তা কক্সবাজারে রয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিরাও আছেন তাদের সঙ্গে।

কেউ রাখাইনে ফিরে যেতে রাজি হলে তাদের সীমান্তে পৌঁছে দিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পাঁচটি বাস ও দুটি ট্রাক প্রস্তুত রাখা হয় টেকনাফের শালবন ক্যাম্পে। প্রস্তুতি নেয়া হয় ঘুমধুম ট্রানজিট পয়েন্টেও।

টেকনাফের কেরণতলী থেকে উখিয়া হয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম এলাকা পর্যন্ত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয় স্থানীয় প্রশাসন। পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত কেউ স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি না হওয়ায় সব চেষ্টাই বৃথা যায়।

রাখাইনের মংডু থেকে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে থাকা মোহাম্মদ ইসলাম তার সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “আমার কাছে জানতে চাইছে, ‘যাবা, না যাবা না বলো’; আমি বলেছি নাগরিকত্ব দেয়ার আগে কোনোভাবে যাব না। আমাদের ভিটেমাটির অধিকার দিতে হবে, যে ক্ষতি করছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, নিরাপত্তা দিতে হবে।”

মিয়ানমারে বিনা বিচারে গ্রেপ্তার থাকা রোহিঙ্গাদের মুক্তি দেয়ার দাবিও রয়েছে নিপীড়নের শিকার এই শরণার্থীদের মধ্যে।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত