ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -২৪)

  শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২০, ১১:০৩  
আপডেট :
 ০৭ জানুয়ারি ২০২০, ১১:০৫

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -২৪)

[দেশের জনপ্রিয় দুটি পত্রিকার (যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন) জন্মের পেছনের ইতিহাস, কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া বিব্রতকর বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ, হস্তক্ষেপ, পত্রিকা প্রকাশের ওয়াদা দিয়ে অন্য একটি জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে নিয়ে এসে পত্রিকা না বের করে হাতজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় দেয়া, পত্রিকা প্রকাশের পর কোন কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কিছু দিনের মধ্যেই ছাপা সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে লাভ খোঁজা, ইচ্ছেমত সাংবাদিক-কর্মচারি ছাঁটাই করা সহ পত্রিকার অন্দর মহলের খবরা-খবর, রাজনৈতিক মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া কিছু রিপোর্ট, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির কিছু ঘটনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে আমার এ বই ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’। জানতে পারবেন সংবাদপত্র জগতের অনেক অজানা ঘটনা, নেপথ্যের খবর।]

(পর্ব -২৪)

সেদিন আমার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয়েছিল তাতে এমন একটি পরিবেশে চাকরি করা সম্ভব কি-না চিন্তাভাবনা করছিলাম। কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময় থেকেই সাংবাদিকতা শুরু করি। মাস্টার্স পাস করে সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করি। একজন জুনিয়র রিপোর্টার থেকে সর্বাধিক প্রচারিত জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক। মানুষের জীবনে আর কী চাই। মান-সম্মান, খ্যাতি সবই হয়েছে। তবে অর্থবিত্ত নেই, সঞ্চয়ও নেই। চাকরি করতেই হবে। চাকরি না থাকলে সংসার চলবে না। এমন একটি অবস্থায় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। সারাজীবনের সাংবাদিকতায় নিজের পেশাগত দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সততা বজায় রাখতে চেষ্টা করেছি। এ ঘটনাটি ছাড়াও আরও কয়েকটি অভ্যন্তরীণ ঘটনা আমাকে নানাভাবে পীড়া দেয়। কিন্তু আমি কিছুতেই মালিকপক্ষকে কোনদিন এসব বিষয়ে জানাইনি। কারণ পত্রিকার সম্পাদক আমি। আমার পক্ষে অধস্তন কাউকে নিয়ে অভিযোগ মানায় না। আর শত সমস্যার মধ্যেও পত্রিকার কোন ক্ষতি হোক তা আমি চাইনি। আগেই বলেছি বিভিন্ন অফিসে এ ধরনের ঘটনা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার জন্য অস্বাভাবিক। আমি মনে করেছি আমি নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। তাই আমাকে সামনে রেখে কারো কারো ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল ইত্যাদি মেনে নেয়া যায় না। তাই মনোব্যথা। সবার জন্য ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যুগান্তরে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। এছাড়াও প্রায় একই ধরনের অভ্যন্তরীণ সমসার সৃষ্টি হয়েছিল। এ-সবই ছিল যুগান্তর ছাড়ার কারণের মধ্যে অন্যতম। মনের মধ্যে যখন এমন টানাপড়েন, তখন একদিন আমার এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ফোন করে দেখা করতে চাইলেন।

আমি তাকে বললাম, আমি নিজেই তার অফিসে যাব। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চিকিৎসক। প্রথমে ছোট একটি ডায়াগনস্টিক দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এখন বড় হাসপাতাল, বড় ডায়াগনস্টিক। ল্যাবএইডের মালিক। ডা. এ এম শামীম। আমি যখন ইত্তেফাকে কাজ করি তখন তাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। সাবেক উপদেষ্টা। সেই থেকে মাঝে মধ্যেই যোগাযোগ হত। তার অনুরোধে অফিসে যাওয়ার পথে মাঝে মধ্যেই ল্যাবএইড থেকে কফি পান করে গেছি। আমি যখন যুগান্তরে কাজ করি তখন তিনি প্রায়ই আমার সঙ্গে মিডিয়া নিয়ে আলোচনা করতেন। খুঁটিনাটি জানতে চাইতেন। মিডিয়ার প্রতি তার আগ্রহও ছিল বেশ। একসময় শুনেছিলাম তিনি টিভি করতে চান। বিএনপি আমলে অনুমোদন পাওয়া একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মালিকানাও নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। টিভিটি তখন অন্যরা নিয়ে যায়। বর্তমানে সম্প্রচারে আছে। এরপর নতুন টিভি চ্যানেল করারও চেষ্টা করেছেন। শ্রদ্ধাভাজন এবিএম মূসা সাহেবকেও তিনি টিভি চ্যানেল করার কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তাও পারেন নি। যেমন অনেকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন পেলেও তিনি এখনও পাননি। কেন পাননি তাকে আমি জিজ্ঞেস করিনি। অন্যদের কাছ থেকে শুনেছি। তিনি প্রায়ই আমাকে ফোন করতেন। কথা হতো।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক হওয়ার পর তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেন। একদিন তার অফিসে কথায় কথায় জানতে চান, ভাল একটি পত্রিকা করতে কত ব্যয় হতে পারে। আমি জানাই পত্রিকার বিষয়টি অন্যান্য ব্যবসার মতো নয়। নিদির্ষ্ট করে ব্যয়ের অংক বলা যাবে না। তবে র্ধৈয ধরে যারাই বিনিয়োগ করেছেন সে সব পত্রিকা ভাল বাজার পেয়েছে। আর ব্যবসাসফলও হয়েছে। আর যারা ছয়মাস, একবছর পর বেতন-ভাতা দিতে পারে না, সার্কুলেশন বেশি হলে কমিয়ে দেয়, ছাঁটাই করে, তাদের পত্রিকা চলেনি, ভবিষ্যতেও চলবে না। পত্রিকা করতে হলে ভাল স্টাফ, চাহিদামতো পত্রিকা সরবরাহ এবং কয়েকবছর অব্যাহত বিনিয়োগ করতে পারলে জনপ্রিয় ও লাভজনক করা সম্ভব। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম কেন, ইচ্ছা আছে কিনা। তিনি বললেন, চিন্তা করছি। আমি বললাম, নামলে বুঝে-শুনে নামবেন। এখনও আমার সাথে পত্রিকা প্রকাশ নিয়ে যারা কথা বলেন তাদের একই কথা বলি। উৎসাহিত না করে বরং নিরুৎসাহিত করি। কেননা ঝোঁকের বশে অনেকে পত্রিকা প্রকাশ করে বেশি দিন চালান না। এতে সাংবাদিক কর্মচারী বেকার হন। সেদিন আর বেশি কথা হয়নি। তবে এরপর মাঝে মধ্যেই কথা হতো। তিনি প্রায় সবসময়ই পত্রিকার কথা বলতেন, ব্যক্তিগত অনেক বিষয় নিয়েও তার সাথে কথা হত। তার সঙ্গে একধরনের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক হওয়ায় মাঝে মধ্যে আমার কিছু মনোবেদনার কথাও বলতাম। এসব কোন সিরিয়াস আলোচনা ছিল না। পরিচিত, ঘনিষ্ঠজনরা আড্ডায় আলোচনায় ব্যক্তিগত, অফিসিয়াল ও পারিবারিক ছোটখাটো বিষয়েতো কথা বলেই থাকেন। আমাদেরও আলোচনা ছিল এরকম। কিন্তু তার ফোনের পরদিন অফিসে গেলে তিনি একটি ভাল বাংলা প্রত্রিকা প্রকাশ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, যদি আমি তার সাথে যোগ দেই তাহলেই পত্রিকা প্রকাশ করবেন। নইলে নয়।

আমি জানতে চাইলাম আপনি বুঝে বলছেন, নাকি আবেগে। আগেই বলেছি সেদিন অফিসের ঘটনাটি কেন জানি আমার মনোপীড়ার কারণ হয়। এর একদিন পরই তার এ প্রস্তাবে আমি সম্মতি কিংবা অসম্মতি কিছু না জানিয়ে শুধু বললাম, আপনি চিন্তা করেন। আমি অফিসে চলে যাই। বিষয়টি নিয়ে আমি আর ভাবিনি। ব্যস্ত ছিলাম। ক’দিন পর আবার ল্যাবএইডের শামীম সাহেবের ফোন। তিনি আমাকে প্রতিদিন ছাড়ার বিষয়ে আমার কোন সিদ্ধান্ত জানতে চাইলেন না। একটা খবর জানালেন। তার বক্তব্যটি এমন, বসুন্ধরা গ্র“পের চেয়ারম্যান অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রতিদিনের মালিক শাহ আলম সাহেব তাকে কিছুক্ষণ আগে ফোন করেছিলেন। ফোনে জানতে চেয়েছেন তিনি যে পত্রিকা বের করবেন তাতে আমি যোগ দিচ্ছি কিনা? আমার সাথে কথা পাকাপাকি হয়েছে কিনা? তিনি কথাটা আমাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেলেন যে, প্রতিদিনে এখন আমার পক্ষে কাজ করা কঠিন। শাহ আলম সাহেব সব জেনে গেছেন। আমি শান্তভাবে তার কাছে জানতে চাইলাম যা কিছু কথা হয়েছে আপনার আর আমার মধ্যে। আপনি পত্রিকা বের করতে চান। আমাকে যোগ দিতে বলেলেন, আমি তো আপনাকে কথা দেইনি। তাহলে শাহ আলম সাহেব জানলেন কী করে? তার তো জানার কথা না। তিনি বললেন, ভাই বসুন্ধরা গ্র“প তাদের কর্মকর্তা কর্মচারী সবার সম্পর্কে খরব রাখে। কে কোথায় যায় তাদের স্টাফ ইত্যাদি। আমার খটকা লাগলো। তবুও বললাম, ঠিক আছে কাল আপনার অফিসে আসব। এসে শুনব। এর মধ্যে আমার মনে বেশ একটি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। কেননা শাহ আলম সাহেব প্রথমে আমাকে বসুন্ধরার উপদেষ্টা পরে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক করেছেন। মালিক-কর্মচারীর মধ্যে যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকে তা আমাদের আছে। আর তিনি মুখ ফুটে কোনদিন আমার কোন কাজ ও দায়িত্ব পালন নিয়ে অসন্তোষও প্রকাশ করেননি। আর এমন করার কথাও ছিল না। পত্রিকা ভাল চলছে। তবে কেন তিনি এমনটি করবেন। আবার ভাবলাম ল্যাবএইডে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কত লোক আসে, কে কোথায় দেখেছে। এমন হতে পারে কেউ গিয়ে তাকে বলতে পারে।

শামীম সাহেব মিডিয়া গড়তে চান এমন আলোচনা তো ছিলই। আমি ভাবলাম এমন অবিশ্বাস থাকলে কাজ করা কঠিন। বিশেষ করে আমাকে জিজ্ঞেস না করে সরাসরি শামীম সাহেবকে। এমন চিন্তাভাবনার মধ্যে পরদিন শামীম সাহেবের অফিসে যাই। আগের মত কফি এলো। কথা হলো। জানতে চাইলাম, আসলেই শাহ আলম সাহেব না অন্য কেউ ফোন করেছিলো। তিনি সিরিয়াসলি বললেন, শাহ আলম সাহেব। আমি মনে মনে ভাবলাম শাহ আলম সাহেবকে কি বিষয়টি জিজ্ঞেস করব? আবার ভাবি তিনি আমাকে কিছু না জানিয়ে যদি শামীম সাহেবকে ফোন করে থাকেন তাহলে আর জিজ্ঞেস করে লাভ কী? আর যদি ফোন না করে থাকেন তাহলে জিজ্ঞাসা করা মানে আরেক জটিলতা। তাই আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি। এভাবে ক’দিন চলল। এর মধ্যে শাহ আলম সাহেবের সাথে অনেকবার দেখাও হয়েছে। কথা হয়েছে। তার কাছ থেকে এমন কোন ইঙ্গিত পাইনি। অফিসে ঊর্ধ্বতন যারা আছেন তাদের কাছ থেকেও কোনো ধরনের আভাস-ইঙ্গিত নেই। কিন্তু আমার মনের মধ্যে একধরনের খটকা লাগছিলো। সর্বোচ্চ মেধা শ্রম ও সময় দিয়ে প্রতিদিনে কাজ করছি। কাগজ দিন দিন ভাল হচ্ছে। কেন এমন সন্দেহ?

চলবে...

বইটি পড়তে হলে সপ্তাহের রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার চোখ রাখুন ‘বাংলাদেশ জার্নাল’ অনলাইনে।

বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন

আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), ঢাকা।

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন

আরএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত