ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

মেয়রের ইশতেহার বিতর্ক ও মহিউদ্দিন চৌধুরী

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২২:৩৬

মেয়রের ইশতেহার বিতর্ক ও মহিউদ্দিন চৌধুরী

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর ধারণা কখনো ভাল ছিল না। বিভিন্ন সময়ে জাতির জনককে নিয়ে হীনম্মন্যতার প্রকাশ ঘটেছে অরুচিকর বক্তব্যে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মেয়াদের ছাত্রলীগ নেতারা এটা ভালই জানেন।

শিবির ও এরশাদের জাতীয় ছাত্র সমাজের হামিদ বাহিনীর সশস্ত্র হামলায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ছাত্রলীগের কোন কোন নেতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লুকানো ক্ষোভের আগুনে বাতাসও দেন। তাঁর হালের অতিরিক্ত বঙ্গবন্ধুপ্রেম কটাক্ষ করে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদের পর বিশ্ববিদ্যালয় মন্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান এর মত গুরুত্বপূর্ণ পদও ‘অলঙ্কৃত’ করেন।

কট্টর বাম দূর্গের আশ্রয় ছেড়ে বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনার নিরাপদ ঘরে গৌরবের সাথে পুনর্বাসিত হয়েছেন। তাঁর কাঙ্ক্ষিত পদ-পদবী অর্জিত না হলে বঙ্গবন্ধু শিবিরে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এত সহজ হতো কিনা, এ নিয়ে গবেষণা অনাবশ্যক।

এখন তিনি অবসরে। সম্মানিত শিক্ষক মহোদয়ের নামটা আড়ালেই থাক। তিনি বঙ্গবন্ধু চর্চায় অসময়েও যদি সচল থাকেন, সেটা হবে জাতির জন্য সেরা সুখবর। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা বড়ই গ্লানির। বাম’তো দূর, বঙ্গবন্ধুর অনেক কাছের জনও ভয়ঙ্কর দহনকালে আমরা হয় ‘কোমা’য় দেখেছি বা খুঁজেও পাইনি।

আসি মূল প্রসঙ্গে। চট্টল কিংবদন্তি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছের জনদের অবগতির জন্য কিছু লুকানো সত্য তুলে আনা খুবই জরুরি। মহিউদ্দিন ভাইকে নিয়ে ব্যক্তিগত নানা স্বাদের স্মৃতি ভান্ডার এত বেশি সমৃদ্ধ, কয়েক খন্ড মুখরোচক কেতাব রচনা করেও শেষ করা অসম্ভব। কসরতটা করতে গেলে দুঃখ-দুর্দশার গনগনে লাভাস্রোতে ভেসে যেতে হবে। তাই বাদ থাক।

তিনি অনেককে অহেতুক ঘড়া ঘড়া অর্থ সূধা গিলিয়ে ‘সুগার লেভেল’ বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার কাউকে বা হলাহল গিলিয়ে কন্টক শয্যা উপহার দিয়েছেন। নিজে কোন দলের নাইবা বলি। যতদূর সম্ভব, নেতা বা ভিআইপি সীমানার আড়ালে রাখি নিজকে। কারণ ব্যক্তিগত। কিন্তু মহিউদ্দিন ভাই বলে কথা। যখন যাকে প্রয়োজন, অনিচ্ছুক হলে পেয়াদার বহর মোতায়েন করে হলেও ধরে আনবেনই। নো, ছাড়াছাড়ি। আমি আর কোন ঝোপের বাগডাঁশ? হয়তো দু’তিন মাস দেখাই নাই। হঠাৎ মাঝরাতে ফোন কল। প্রথম প্রথম ধরতাম। সাথে সাথেই লম্বা সালাম [আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়া রাহমুতুল্লাহে বরকাতুহু] সালামের উত্তর না শুনেই বলতেন, ওয়া হুজুর কি গরজ্জে [হুজুর কী করো]? প্রথম প্রথম ঘুম প্রস্তুতির কথা বলতাম। শুনে উনি ব্রান্ডেড এমন ঠাট্টা করতেন, যা লেখা সম্ভব না। পরে বাসায় যাওয়ার ফরমান। তখন ঘড়ির কাঁটা হয়তো রাত একটার ঘরে। সরাসরি এড়িয়ে গিয়ে সকালে যাওয়ার কথা বলতাম। ‘না’ শুনেও জোড়াজুড়ি করতেন না কখনো। এরপর অমন ফোন আসলে পাল্টা আরো বড় ফাজলামিতে নামতাম। আসল বিষয়, পরদিন দেখা করার নোটিশ। আর ভুল করে রাতে ছুটলে টানা আড্ডা। ওনি ঘুমাতেন ভোররাতে।

সকালে গেলে একান্ত সহকারী ওসমান বা সিটি কর্পোরেশনের কম্পিউটার অপারেটরকে ডেকে আমাকে ই মেইল ঠিকঠাক করে দেয়ার নির্দেশ দিতেন। শেষ করে ওনাকে পড়ে শোনাতে হতো। নিশ্চিত হয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি পদাধিকারী বা বিদেশি কোন প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তাকে পাঠাতেন। এমন কী মোবাইলের ইংরেজি এসএমএসও দেখিয়ে নিতেন। কে তৈরি করেছে, জানতে চাইলে খেপে যেতেন। বলতেন, তোমার দরকার কী? তোমারটা তুমি দেখ।

এমন কাজের পাশাপাশি টুকটাক আরো কিছু স্পর্শকাতর কাজ করে দিতে হতো। তিনি সুন্দর ও নির্ভুল পরিবেশনা পছন্দ করতেন। আবার সুযোগ সন্ধানী অনেকে তাঁকে বিভ্রান্ত করতেন। ভাষার বাসি অচল অলঙ্কার গছিয়ে বাহবা, তোহফা দুটোই হাতাতেন। ইনারা সবাই বড় বড় ‘স্কলার’ ও দাপুটে ‘মিডিয়া এক্সপার্ট’! প্রচুর সম্পদ, ব্যাবসাপাতি, নাম প্রভাব! না বুঝে মাঝে মাঝে মন্তব্য করতে চাইলে ওনি খেপে গিয়ে হাতের আড়ালে চোখ টিপে বলতেন, এঁরা ‘স্যার’ মানুষ, অমুক পত্রিকা বা টিভির এতবড় সাংবাদিক! লাখ টাকা বেতন, বাড়ি, গাড়ি! তোমার কী আছে? আজাদীর চাকরি ছেড়ে ‘ডং ডং মদন’!

প্রতিবাদ না করে মেনে নিতাম, তাঁর উল্টাপাল্টা খেয়ালি কথায় দাড়ি টানতে। তাঁর আচরণে হাসতাম চুপচাপ। অর্থ- বিত্ত, পদ-পদবী লেজুড়ের নিচে জ্ঞান, মেধা, লেখা-পড়ার ভয়ঙ্কর অবনমন দেখে কষ্ট হতো। আসলে ওই ফাঁকটাই আমার জীবিকার উর্বর জমি! আরে যা, পেশাগত গোপনীয়তা কখনো ফাঁক করতে নেই! কিন্তু আশ্চর্য, নিজের মাত্র ২২ বছরের ছোট্ট অকাল প্রয়াত প্রাণাধিক আদরের কন্যা ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পার নাজুক কাজ চাপান ‘ডং ডং মদনের ঘাঁড়ে’! এখন ভালই বুঝি, এসব কথা ওনার গালি না, বরং সততা, দক্ষতার স্বীকৃতি। ‘বউ মেরে মা’কে শিক্ষা’ দেয়ার কৌশল মাত্র।

ভাবুনতো একবার, মহিউদ্দিন ভাইয়ের জীবন, সংগ্রাম, বৈচিত্র্য, নিজস্ব ধারায় সিটি কর্পোরেশন চালানোর কৌশল ও রাজনীতি নিয়ে শত কেতাব রচনা কত সহজ বিষয়। কিন্তু প্রিমিয়ার ভার্সটির ইংরেজি বিভাগের মাত্র ৬ষ্ট সেমিস্টারের একজন ছাত্রী টুম্পাকে নিয়ে কীভাবে শতাধিক পৃষ্ঠার দু’দুটো স্মারক প্রকাশনা সম্ভব! উপন্যাস সম্ভব হলেও প্রামাণ্য গ্রন্থ, কখনো না। টুম্পা বিশেষ কেউ না, জীবিত থাকতে ছিল বাবার প্রভাব সূর্যের ছায়ার নিচে। বিস্ময়কর কিছু গুণ থাকলেও বাপ সূর্যের আলোয় ম্নান। অথচ অকালে মেয়ে হারিয়ে দু’ ভাষার আলাদা দু’ গ্রন্থে [২০০৯ ও ২০১৫ সাল] নিজের চে’ও মহিয়ান গরিয়ান করে আলোয় তুলে আনেন টুম্পাকে! তাও অসহনীয় প্রতিবন্ধকতা ঝেড়ে ফেলে।

আসলে নিজের ভিতরের অব্যক্ত বেদনা, অহর্নিশ ক্ষরণ আমাকে মাধ্যম বানিয়ে ঝেড়েছেন তিনি। কদ্দূর আস্থা এবং বিশ্বাস থাকলে নমস্যদের এড়িয়ে কাজটির জন্য বার বার ‘ডং ডং মদন’কে বাছাই করেন, ভাবতেই শরীর রোমাঞ্চিত হয় এখনও! হ্যাঁ, কাজগুলো করে আমি নন্দিত না, চরম ধিকৃত এবং আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছি! ধিক্কার চলছেই, মরার আগ পর্যন্ত থামবেইনা। শেষ বইটাসহ বিজয়মেলার ‘বিজয়’ প্রকাশনা প্যাকেজের অর্ধেক টাকাও শোধ করতে পারেন নি। তাঁর অনিচ্ছাকৃত অপারগতা নিয়ে মন্তব্য করা অসম্ভব! কেন, প্রশ্নের উত্তর নেই।

বিশেষ কারণে নাজুক ঘটনাগুলো আলোতে আনতে বাধ্য হলাম। চট্টগ্রামের নব নির্বাচিত সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বাহ্নে ইন্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে এক পরামর্শ সভা আয়োজন করেন। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সেখানে মতামত রাখেন। নিজেও আমন্ত্রিত দর্শক। এক আলোচক চট্টগ্রাম ভার্সিটির সাবেক ভি সি অধ্যাপক ড.ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী নিশ্চিত প্রজ্ঞাবান ব্যাক্তিত্ব ও স্কলার। কিন্তু বক্তব্যে তিনি অহেতুক নতুন মেয়রকে খাটো করেছেন। বলেছেন ‘তাঁর টানা সাত/আটমাসের গবেষণা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের ফসল সিটি মেয়রের নির্বাচনী ইশতেহার। তিনি নিজে কঠিন শ্রম দিয়ে ইশতেহারটি প্রণয়ন করেছেন!’

এই মাননীয় হালে নানা পত্রিকায় অসংখ্য হাবিজাবি ‘কলাম’ ছাপান! অবশ্যই সম্মানিত ব্যাক্তিত্ব তিনি। কিন্তু কেন অপ্রাসঙ্গিক বিষয়টা টানলেন, কোনভাবেই মাথায় আসেনি। ইশতেহার মেয়র মহোদয়ের। বাস্তবায়নও তিনি করবেন। কাকে দিয়ে রচনা করিয়েছেন, সেটা আড়ালের বিষয়। ওটা কেউ নিজের তৈরি দাবি করলে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠক জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর মত হীনম্মণ্যতা নয় কী? জানিনা, সাবেক ভিসি সাহেব কেন প্রকাশ্য সমাবেশে এমন বেতাল কাজ করলেন? বেশ কটি পোষ্ট ও মিডিয়ায় লিখেছি, রেজাউল ভাই আমার বিশেষ বন্ধু। তিনি ইশতেহার তৈরিতে অনেকের মতামত নিয়েছেন। আমিও ওনার পক্ষে চ মে ক উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা, নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ বেশ ক'জন পেশাজীবির মতামত নিয়েছি। ওইমত ইশতেহার প্রণীত হয়েছে। কে বা কারা এটা সাজানো ও প্রণয়নের কাজ করেছেন রেজাউল ভাই, তাঁর পরিবারের সদস্যসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে জানেন। একদফা না, করোনার আগে পরে দু’দফায় কাজটি করতে হয়েছে।

ওদিনের অনুষ্ঠানে যাই ১২টার পর। অভ্যাস মত বসি সবার পেছনে। দু’এক ব্যাতিক্রম ছাড়া ঘন্টা ধরে তেলানো বক্তৃতা, গর্জন শুনে বিরক্ত হয়ে চলে আসি। মেয়র মহোদয় যে মহান উদ্দেশে বৈঠক ডেকেছেন, তা কতটুকু সফল, তিনিই ভাল বুঝবেন। পরে ফোনে বেশ ক’জন শুভাকাঙ্ক্ষী সাবেক ভি সি সাহেবের ভাষণের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেন। একটু বিস্মিত হই, এমন শিশুসুলভ কাজ ইফতেখার সাহেবের পক্ষে কীভাবে সম্ভব! ইশতেহারের পরিবেশনাশৈলী কী ওনার রচনারীতির সাথে যায়! যদি না যায়, সর্বোপরি মেয়রের ইশতেহার নিজের প্রণয়ন বলে দাবী কী হাস্যকর নয়? সম্ভবত তিনি আরো বড় পদ বা ইউজিসি চেয়ারম্যান পদ টার্গেটে রেখেছেন। ওটা পেতে সাবেকটির মত একই কায়দায়, একইভাবে গুছিয়ে পা পা এগুচ্ছেন। এটা হলেতো আমাদেরই গৌরব অবশ্যই। কিন্তু তাই বলে++কেন স্ক্রিপ্ট চুরি!

নিরেট সত্য হচ্ছে, ইশতেহারে প্রণয়নের সব তথ্য উপাত্তের সফ্ট ও হার্ড রেকর্ড নিজের কাছে আছে। পাবলিক করা যায় অনায়াসে। কিন্তু এতে ছোট করা হয় মেয়র মহোদয়কে। আশা করি, সাবেক ভি সি মহোদয় আরেকটু সতর্কভাবে এগুবেন।

প্রসঙ্গক্রমে মহিউদ্দিন ভাইয়ের ই-মেইল বা খুদে বার্তা ডেকে নিয়ে দেখানোর রহস্যটি ঘটনার পর পরিস্কার হয়ে গেল! এটাও পরিস্কার, কেন আমাকে ‘ডং ডং মদন’ আদুরে ডাকে আপ্যায়িত করতেন! আসলেই আমি দড়িখোলা গয়ার ষাঁড় আস্ত!

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বাংলাদেশ জার্নাল/কেআই

  • সর্বশেষ
  • পঠিত