ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪১ মিনিট আগে
শিরোনাম

ভালোবাসার বিভূতিভূষণ এবং সত্যজিৎ

  রিয়াজুল হক

প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২১, ১৭:১০

ভালোবাসার বিভূতিভূষণ এবং সত্যজিৎ

মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্যবই, খুলনার রেলওয়ে মাঠ, লোকো মাঠ মোটামুটি এর মধ্যেই সব সময় থাকা হতো। স্কুল আর ক্রিকেট। এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য বই পড়ার অভ্যেস আমার ছিল না। আমার বন্ধুরাও ছিল ঠিক আমার মত। সিলেবাসের বাইরের বই পড়ে আসলে কি হবে? পরীক্ষায় তো আসবে না। আমাদের সকলের মনোভাব ঠিক এরকমই ছিল।

স্কুল, প্রাইভেট, ক্রিকেট, গল্প, ঘুরে বেড়ানো এসব নিয়েই নিয়ে সময় পার হয়ে যেত। এক বন্ধু খুব ভালো গান লিখত। নিজে গান লিখে পরের দিন আবার শোনাত। আরেক বন্ধু জহির আহমেদ, মান্না দে'র গান খুব ভালো গাইত।

এসএসসি পরীক্ষার পর অফুরন্ত সময়। সকালে একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠি। ঘুরে বেড়াই। দুপুরে বাসায় এসে খেয়ে আবার বের হই। ভালোই সময় যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন কাকু আমাকে একটা বই এনে দিল। আদর্শ হিন্দু হোটেল। লেখক- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি পড়া শুরু করলাম। মনে হচ্ছিল আমি গল্পের মধ্যে ঢুকে গেছি। একটু উপন্যাস যে মানুষকে নেশার মত টানতে পারে, আমার জানা ছিল না।

এক অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করেছিল বইটা পড়ার সময়। মনে হচ্ছিল ভবিষ্যতে আমার একজন আদর্শ বাবুর্চি হওয়া উচিত। আমার রান্না করা খাবার খেয়ে মানুষ প্রশংসা করবে, ভালো বলবে। ইচ্ছা হলে হোটেল খুলবো, ভালো না লাগলে বন্ধ করে রাখবো। উপন্যাসটি খুব সম্ভবত এক দিনেই পড়ে শেষ করেছিলাম। মনের মধ্যে খুব ইচ্ছা ছিল যে বিভূতিভূষণের যদি আরও উপন্যাস পেতাম, তাহলে পড়ে ফেলতাম।

যাই হোক, আদর্শ হিন্দু হোটেল উপন্যাসটি পড়ার পরেরদিন ভৈরব নদীতে একটি কার্গোর উপরে আমরা কয়েক বন্ধু আড্ডা দিচ্ছিলাম। বেলা তিনটে বাজবে তখন। জীবনে প্রথম একটা উপন্যাস শেষ করলাম। এখন এর কাহিনী যদি বন্ধুদের কাছে বর্ণনা না দিতে পারি, তাহলে হবে কি করে? পুরো কাহিনীটি বলার জন্য আমি খুবই আগ্রহী ছিলাম। মনে হচ্ছিল, পুরোটাই যেন মুখস্ত করে এসেছি। বলে রাখা ভালো, সে সময় আমাদের কেউ শঙ্খ, সংগীতা, স্টার কিংবা পিকচার প্যালেস সিনেমা হলে মুভি দেখে আসলে, বন্ধুদের সামনে কাহিনী বর্ণনা করতো। যে যার মত একটু ভাব নেয়ার চেষ্টা করতাম।

আমি 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' উপন্যাসটির কাহিনী ওদের কাছে বলা শুরু করলাম। আমার কাছে অবাক লাগল। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে আমি উপন্যাসের বর্ণনা ওদের কাছে বলে যাচ্ছিলাম। সবাই খুব মন দিয়ে শুনলো। কারো মুখে কোন কথা ছিল না।

শেষ করার পরে বললাম, হাতে টাকা পেলে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্য বই কিনব। কারণ আমাদেরকে পকেটমানি দেয়া হতো না। যখন বই-খাতা-কলম লাগতো, কিনে দেয়া হতো। স্কুলে যেদিন চারটা পর্যন্ত ক্লাস হত, সেদিন টিফিনের জন্য ২টা সিঙ্গারা খাওয়ার জন্য টাকা পেতাম। আর এখন তো স্কুলের ক্লাস নাই, টিফিনের টাকা পাওয়ার সুযোগ নাই।

পরের দিন আরেক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। আমার জন্য অনেকটা অতি বিস্ময়। কারণ আমার এক বন্ধু 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' এর বর্ণনা শোনার পর, সে আমার জন্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি নতুন উপন্যাস কিনে এনেছিল। পথের পাঁচালী।

এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সময় রিক্সা ভাড়া দেয়া হতো। সেখান থেকে কিছু টাকা বেঁচে ছিল। সেই বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়ে আমার সেই বন্ধু দোলখোলা মোড়ের পুরানো বইয়ের দোকান থেকে পথের পাঁচালী কিনে এনেছিল। পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কিনলেও বইটা ছিল একেবারেই নতুন। দোকানদার বলেছিল, এই উপন্যাসটা খুব ভালো। সেজন্যই পথের পাঁচালী কেনা। আমাকে পথের পাঁচালী দিয়ে প্রথম শর্ত দিল, তুই দুই/এক দিনের মধ্যে বইটা পড়া শেষ করবি এবং উপন্যাসের ঘটনা বলবি।

এখন যদি কেউ এরকম আবদার করত, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলতাম, ভাই আগে তুমি পড়া শেষ করো, তারপর আমাকে দিও। কিন্তু সেই সময় এই কথা বলার অবস্থা ছিলনা। আমি তো অপেক্ষায় আছি, কখন বিভূতিভূষণ এর নতুন একটা বই পড়বো? খুব খুশি হয়ে পথের পাঁচালী নিয়েছিলাম।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন সন্ধ্যা হবার একটু আগেই বাসায় ঢুকলাম। উদ্দেশ্য একটাই, তাড়াতাড়ি পড়া শুরু করতে হবে। এমন সময় আমার এক বন্ধু বাসার সামনে এসে ডাকাডাকি শুরু করলো। একটু আগে সে একটি সিনেমা দেখে এসেছে। এখন সেই সিনেমার কাহিনীর শোনাবে। আমি তো দেখলাম মহাবিপদ। আমি পথের পাঁচালী পড়ে শেষ করতে না পারলে তো অন্য কোনো কিছুতেই মন দিতে পারব না। আমি তাকে বোঝালাম, আগামীকাল সকাল দশটার সময় বের হচ্ছি। সবাই মিলে শুনবো। আর এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তুই ভালো করে বলার সময়ও পাবি না। বোঝানোর পরে আমার সেই বন্ধু বাসায় চলে গেল।

আমি পথের পাঁচালী পড়া শুরু করলাম। শেষও করলাম। উপন্যাসটি পড়ে শেষ করার পর, বছর তিনেক আগের একটা অনুভূতির কথা মনে হচ্ছিল। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। নবম শ্রেণীতে নতুন কারিকুলাম হয়েছে। বাংলা বইয়ের আগের গদ্য-পদ্য চেঞ্জ হয়ে গেছে। আব্বা বিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও একদিন বেশকিছু ছাত্র-ছাত্রীর সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' গল্পটি পড়ে শোনাচ্ছিল। ফটিকের দুরন্তপনা, বদ্ধ ঘরে আটকে থাকার কষ্ট ইত্যাদি শুনতে শুনতে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। আজ এতদিন পর পথের পাঁচালী শেষ করে আমার সেই একই অবস্থা। পরবর্তীতে এরকম অনুভূতি আজ পর্যন্ত আমার আর হয়নি।

ছোটবেলা থেকেই যে কোন আনন্দ হোক কিংবা দুঃখ হোক, আমার মাথার মধ্যে বেশি সময় অবস্থান করে না। সব সময় একটা বিষয় মনে হতো ‘হইতেই পারে’। কোন কিছুই আমাকে তেমন উচ্ছসিত করে না, আবার দুঃখও দেয় না। কিন্তু 'ছুটি' আর 'পথের পাঁচালী' এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল। পথের পাঁচালী শেষ করার পরে অপরাজিত, ইছামতি, আরণ্যক, কেদার রাজা, দৃষ্টি প্রদীপ, চাঁদের পাহাড়, বিধু মাস্টার, দেবযান, অশনি সংকেত অর্থাৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা যা যা পাওয়া যায়, মোটামুটি পড়ে ফেলেছিলাম। আমার কাছে এখনো অসাধারণ লাগে তার লেখাগুলো।

পরে জেনেছিলাম, পথের পাঁচালী নিয়ে সত্যজিৎ রায় সিনেমা করেছিলেন। সেই সিনেমাটা দেখলাম। পথের পাঁচালী নিয়ে সিনেমা যদি সত্যজিৎ রায় না করে অন্য কোন পরিচালক করত, তাহলে মনে হয় এতটা হৃদয়গ্রাহী হত না। মনে হয়েছিল, লেখকের ভেতরটা যেন সত্যজিৎ রায় পড়ে এসে, সিনেমাটা তৈরি করেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যায় ১৯৫০ সালে আর পথের পাঁচালী মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালে।

তারপরেও সিনেমাটা দেখে মনে হয়েছে, পরিচালক যেন লেখকের সাথে প্রতিটা সিকোয়েন্সে কথা বলেই সিনেমাটা তৈরি করেছেন। সত্যজিৎ রায় পরবর্তীতে বিভূতিভূষণের অপরাজিত, অপুর সংসার, অশনি সংকেত নিয়েও সিনেমা করেছেন। 'বাক্স বদল' সিনেমার চিত্রনাট্য এবং মিউজিকও সত্যজিৎ রায়ের করা। আমার কাছে মনে হয়েছে সত্যজিৎ রায় এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় একটা ম্যাজিক কম্বিনেশন। তিনি লেখকের লেখাগুলোকে বাস্তবে চরিত্রায়ন করতে যেন পুরোপুরি সিদ্ধহস্ত।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ জার্নাল/এমএম

  • সর্বশেষ
  • পঠিত