ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২০ মিনিট আগে
শিরোনাম

বঙ্গবন্ধু: জ্ঞান ক্ষুধার আশ্চর্য টনিক

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২১, ১৬:৩৬

বঙ্গবন্ধু: জ্ঞান ক্ষুধার আশ্চর্য টনিক

বিস্ময়কর হলেও সত্য, বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ছাড়াও বঙ্গবন্ধু উর্দু, হিন্দি আঞ্চলিক ভাষার মতো কঠিন জাপানি, ফরাসি ভাষাও স্বচ্ছন্দে চর্চা করতেন। ইংরেজিতে তার দখল, স্টাইলিশ বাচন এবং ইডিয়ম প্রয়োগের দক্ষতায় বৃটিশ রাজনীতি পণ্ডিতরাও বিস্ময় মানেন। বিশ্ব-সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, দর্শনসহ সব বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অগাধ পাণ্ডিত্য, সবখানে তিনি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসতেন। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন শীর্ষ সম্মেলন ও গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণ, বিশ্বসেরা মিডিয়াগুলোয় দেয়া সাক্ষাৎকার পড়লে দেখলে-শুনলে পরিস্কার হয়ে যাবে, বঙ্গবন্ধু কতো বড় মাপের জ্ঞানি ও দূরদর্শী নেতা ছিলেন!

আমাদের কোন কোন তথাকথিত জ্ঞানপাপী, সবজান্তা তার একাডেমিক শিক্ষা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করলেও তিনি পাত্তা দেননি, বরং এড়িয়ে গেছেন। তিনি জানতেন কচু ঝাড়ের সাথে বটবৃক্ষের লড়াই হয় না! তাই করুণার পাশাপাশি উল্টো ‘পুরস্কার ভিক্ষা’ দিয়েছেন ওদের কাউকে, কাউকে! এটা ঠিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকতে ভার্সিটির ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবির পক্ষে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে তাকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়। তারপর বাংলা ভাষার দাবিতে জিন্নাহকে চ্যালেঞ্জ করায় ঢুকতে হয় জেলে। এরপরের ইতিহাস চর্চা অনর্থক। কারণ, তা সবার জানা।

সমর দাবি ও বুদ্ধিবৃত্তির ভাঙন মেরামতে এসব বিষয় চর্চা এখন খুব বেশি জরুরি। বঙ্গবন্ধু শুধু একটি রাষ্ট্রের নির্মাতা নন, তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ অন্যতম বিশ্বসেরা ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা শুধু ভাষণ নয়, অমর কাব্যও। বঙ্গবন্ধুর ভরাট কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দেই কবিতার ব্যাঞ্জনা, দ্যোতনা, ছন্দ ও সূরের ঝংকার ধ্বনিত হয়েছে। অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ, সাক্ষাৎকারেও ইংরেজি শব্দ ও বাক্য আরো বেশি বাঙময় ও জীবন্ত! কীভাবে!

আসলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বড় মাপের পাঠক। তার ৫৫ বছরের ছোট্ট জীবনের অর্ধেকের বেশি কেটেছে কারাগারে। বাকি অর্ধেকের বেশি কেটেছে বাংলার মাঠে-ঘাটে-প্রান্তরে উল্কার মতো ছুটতে ছুটতে। হিসাব করলে দেখা যাবে, মোট জীবনের মাত্র ১০ বছরও তার ঘরে থিতু হওয়া হয়ে উঠেনি। জেল জীবনে এক কারাগার থেকে আরেক কারাগার ছিল বঙ্গবন্ধুর নিত্য রুটিন ভ্রমণ। এমনকি সকালে এক কারাগার থেকে সন্ধ্যায় আরেক কারাগারে তাকে স্থানান্তর করা হতো।

পৃথিবীর অন্য কোন বড় নেতার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। কারাগারের নিঃসঙ্গ জীবনে বই ছিল বঙ্গবন্ধুর সবচে' প্রিয় বন্ধু। জেল পাঠাগারের সব বইতো ছিলই। বেগম মুজিবসহ পরিবারের সদস্য, রাজনৈতিক বন্ধুরাও তাকে দেখতে গেলে পছন্দের বই অবশ্যই সাথে থাকতোই। কারা কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিলে কিছু ঢুকতো, বাকিগুলো নয়। এভাবে দেশ ও বিশ্ব সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস মনিষীদের জীবনী হয়ে যায় তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। জেলে সরবরাহ করা নির্দিষ্ট পত্র-পত্রিকাতো ছিলই।

স্বাভাবিক কারণে বঙ্গবন্ধু লেখাপড়া, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, জীবন বোধও সমকালীন সবাইকে ছাড়িয়ে যান। শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মদাতা নন, জ্ঞানে, প্রজ্ঞায় বঙ্গবন্ধুর তুলনা তিনি নিজেই। প্রতি মুহূর্তে নিজকে ছাড়িয়ে অনন্য এক উচ্চতায় উঠে গেছেন এই হিরণ্ময় পুরুষ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, বাণী, সংসদীয় বক্তৃতা, বিবৃতি, বিভিন্ন বিদেশি মিডিয়ার সাক্ষাৎকার, আন্তর্জাতিক শীর্ষ বা দ্বিপাক্ষিক সম্মেলনগুলোতে প্রদত্ত সব ভাষণ সংরক্ষিত আছে কিনা জানা নেই। যদি থাকে, এগুলো নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও চর্চার সময় এসেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি বক্তব্যই দীর্ঘ বিশ্লেষণ ও আলোচনার দাবি রাখে। কারণ, তিনি শুধু বাংলাদেশের জনক নন, সর্বকালের অন্যতম সেরা রাষ্ট্রনেতা, দার্শনিক এবং চিন্তাবিদও। আশা করি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বঙ্গবন্ধু গবেষকরা এ ব্যাপারে দ্রুত মনোযোগ দেবেন।

আরেকটা জরুরি বিষয় না বললে নয়। আওয়ামী লীগের বড় নেতা, মন্ত্রী, এমপি ও অন্যান্য অনেক দায়িত্বশীলের বক্তব্য, বচন, মন্তব্যসহ নানা আচরণে স্পষ্ট, সরকার ও দলে জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতার তীব্র খরা চলছে। প্রকৃত বঙ্গবন্ধু অনুরাগীরতো এমন ঘাটতি থাকার কথা না! মনে রাখা উচিত, বঙ্গবন্ধু এবং একমাত্র বঙ্গবন্ধু চর্চা,পাঠ, গবেষণা ও অনুসন্ধানেই আমাদের আত্মঅনুসন্ধান সম্ভব। পাঠাভ্যাস ছাড়া এটা অসম্ভব। এখন নেতারা বচন, অঙ্গভঙ্গি, পদ, ক্ষমতা ছাড়া সব ভুলে গেছেন। এতে জোকার ও ভাঁড় উৎপাদন যত সহজ, খাঁটি বঙ্গবন্ধু ভক্ত, অনুরাগী হওয়া ততটাই কঠিন! দুঃখজনক হলেও সত্য, জননেত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও সম্প্রতি চীন ভ্রমণের ডায়েরি প্রকাশিত হলেও বইগুলো নেতারা সংগ্রহে রাখতে যত আগ্রহী পড়তে মোটেই ততটা নন।

আসলে যত মাতম, নর্তন-কুর্দন ও প্রচারণা হচ্ছে, সব নিজের পাতে ঝোল টানার কৌশল মাত্র! পঠন-পাঠন ও জ্ঞানের টানা চর্চায় ভিতরের লোভী দানব খুন হয়, দেশপ্রেম পোক্ত হয়, বঙ্গবন্ধুকেও খুব সহজে চেনাজানা যায়। এই শিক্ষা বঙ্গবন্ধু নিজে দিয়ে গেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনুসারী দাবিদার বেশির ভাগ ক্ষমতাধর দিন দিন বোধ, মেধা ও মননহীন দ্বিপদী হওয়ার প্রতিযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন সমানে।

দেশের মহান সারথি বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিবেদিত নেতাকর্মীরা দ্রুত সতর্ক না হলে আকাশের সীমানা ছোঁয়া বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুকে সঠিকভাবে চেনা ও জানা সম্ভব না। ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধু পাঠ ও চর্চা না হলে দেশ যত বেশি উন্নত হোক, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের শোষণ, বঞ্চনামুক্ত, দেশপ্রেমের নির্যাসসিক্ত সোনার বাংলা গড়া কখনো সম্ভব হবে না।

মোস্তফা কামাল পাশা, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত