ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

‘ম্যারাডোনা’ একটি স্বপ্নের নাম

  বোরহান বিশ্বাস

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২০, ১৯:১০  
আপডেট :
 ২৮ নভেম্বর ২০২০, ১৯:৫৭

‘ম্যারাডোনা’ একটি স্বপ্নের নাম
ম্যারাডোনা। ছবি: সংগ্রহ।

তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। ঢাকার খিলগাঁওয়ে আমাদের বাড়ি। ঘর ছেড়ে বাইরে সবেমাত্র খেলাধুলা শুরু করেছি। বাসার সামনে আধপাকা রাস্তা। সেখানেই সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম। ছেলেদের খেলা বলতে ফুটবলই ছিল অন্যতম অনুষঙ্গ। ক্রিকেট অতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। দেশীয় ফুটবলে আবাহনী, মোহামেডান, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, বিআরটিসি, ধানমন্ডি, পিডব্লিউডি, রহমতগঞ্জ, ফরাসগঞ্জ, ফকিরেরপুল, ওয়ান্ডারার্সসহ আরো অনেক দল। আর বিশ্বকাপ বলতে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, হল্যান্ড, রোমানিয়া, পর্তুগাল, কলম্বিয়াকে বুঝতাম। মনে আছে, এশিয়া থেকে তখন দক্ষিণ কোরিয়াও বিশ্বকাপে খেলেছিল।

১৯৮৬ সাল। মেক্সিকোতে বসবে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর। খেলা দেখতে বড় ভাই ১৪ ইঞ্চি একটি সাদাকালো নিক্কন টেলিভিশন কিনে এনেছেন। লাল রঙের প্লাস্টিক বডি। ওই সময় এখকার মতো রিমোর্ট কন্ট্রোল ছিল না। ম্যানুয়েল টিভি। হাতেই অফ, অন। কব্জি বাঁকিয়ে কট কট করে চ্যানেল পরিবর্তন করতে হতো। শুয়ে-বসে খেলা দেখলেও চ্যানেল পরিবর্তন করতে কিংবা টেলিভশন বন্ধ করতে ওঠা ছাড়া কোনো গতি ছিল না।

৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। তবে, দেশকে চিনে ওঠার আগে মাঠের একজন মানুষকে চিনেছিলাম। তার নাম ‘ম্যারাডোনা’। পরিচয়ে একজন মানুষ যে একটি দেশকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে সেটি বুঝেছি তাকে দেখে। নিজের অজান্তেই ম্যারাডোনার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সাদা-আকাশীর প্রেমে পড়ে ভালোবেসেছিলাম আর্জেন্টিনাকে।

ওই সময় বাচ্চাদের উপযোগী বিভিন্ন রঙের টিশার্ট, হাফ প্যান্টে ম্যারাডোনার ছবির সিল মেরে বিক্রি করা হতো। জার্সির গায়ে ১০ নম্বর বসানো নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত বন্ধুদের মধ্যে। আমাদের মধ্যেও এমন মজার ঘটনা ঘটেছে। ম্যারাডোনা তখন আমাদের কাছে স্বপ্নের একটি নাম। মনে আছে, শীতে ম্যারাডোনার ছবি খচিত একটি টি শার্ট পেয়েছিলাম। গরমেও সেটি পরে ফুটবল খেলতাম। নিজেকে ম্যারাডোনা মনে করতাম!

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টনা তাদের প্রথম খেলায় দক্ষিণ কোরিয়াকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে শুভ সূচনা করে। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের। দ্বিতীয়ার্ধের ৬ মিনিটে ম্যারাডোনা ‘ঈশ্বরের হাতে’ সেই গোলটি করেন। এর মাত্র চার মিনিট পর তিনি আরো একটি গোল করেন। যেটি ‘শতাব্দির সেরা গোল’ হিসেবে খ্যাত। একক নৈপূণ্যে তিনি মাঝ মাঠ থেকে পাঁচজন ইংরেজ খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে গোলটি করেন। শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে জয়ী হয়েছিল। ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর খেলায় ৩-২ গোলের ব্যবধানে জয় লাভ করে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে নয়। ম্যারাডোনাকে প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত করা হয়।

৯০-এর বিশ্বকাপে আমাদের টিনসেড বাড়ির উঠোনে বসানো হয়েছিল সাদাকালো টেলিভিশন। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষরা সবাই অফিস সেরে রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে টেলিভিশন সেটের সামনে এসে একে একে বসতেন। প্রথম খেলা ৮৬-এর চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা ও নবাগত ক্যামেরুন। ওই সময় মাঝ রাত পর্যন্ত জেগে থাকা অনেকটা চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল। একমাত্র চ্যানেল ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। রাত ১২টায় কোরআন তেলাওয়াত ও জাতীয় পতাকা প্রদর্শনীর মাধ্যমে তা বন্ধ হয়ে যেত।

পারিপার্শ্বিক কারণেই সবাই তখন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে খুব ভোরে উঠে যেতেন। যা হোক, ঢুলু ঢুলু চোখে টিভি সেটের সামনে গিয়ে বসলাম। এক সময় খেলা শুরু হলো। নতুন হিসেবে ভালো খেলছে ক্যামেরুন টেকনিকের সঙ্গে পেশিও চালাচ্ছে সমানতালে। ম্যারাডোনাকে কড়া মার্কিংয়ে রাখা হয়েছে। সাপোর্ট না পাওয়ায় সহযোগী খেলোয়াড় ক্যানেজিয়াও সুবিধা করতে পারছেন না। ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠলাম। হঠাৎ আর্জেন্টিনার জাল স্পর্শ করলো বল। এগিয়ে গেল ক্যামেরুন। মনটা ভীষণ খারাপ হলো। উঠবো উঠবো করছি। এক পর্যায়ে ক্যানিজিয়াকে ফাউল করায় ক্যামেরুনের দুই খেলোয়াড় লাল কার্ড পেলেন। আবার বসলাম অঘটনের আশায়। শেষ পর্যন্ত সেই খেলায় ক্যামেরুনই জয়ী হয়েছিল মাকানাকির গোলে। রজার মিলারও ভালো খেলেছিলেন।

দ্বিতীয় পর্বে আর্জেন্টিনা প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে। পুরো খেলায় ব্রাজিল ভালো খেলে। আর্জেন্টিনা হাতে গোনা মাত্র কয়কটি সুযোগ তৈরি করে। এরই মধ্যে একবার ম্যারাডোনার দুর্দান্ত এগিয়ে দেয়া একটি বলে সতীর্থ ক্যানেজিয়া ব্রাজিলের জালে বল ছুঁইয়ে দেন। আর্জেন্টিনা ১-০ গোলের ব্যবধানে জয়লাভ করে। ফাইনালে তারা টানা দ্বিতীয়বারের মতো মুখোমুখি হয় জার্মানির। বিতর্কিত একটি পেনাল্টি থেকে খেলার একমাত্র গোলটি করেন জার্মানির আন্দ্রেস ব্রেহমি।

ম্যারাডোনার সামনে তখন পর পর দুবার বিশ্বকাপ ট্রফিতে চুমু খাওয়ার হাতছানি। কিন্তু তা আর হয়নি। ১-০ গোলের হারে স্বপ্ন ভেঙে যায় আর্জেন্টিনার। ফুটবলপ্রেমী কোটি দর্শকের মন ভেঙে হয় চৌচির। এমন ৯০ মিনিটের দ্বৈরথের ইতিহাস যে ঘটবে অলিস্পিকোতে তা কেউই ভাবতে পারেননি! আর্জেন্টিনার হেরে যাওয়ার জন্য নয়। সেদিন বিশ্ব দেখেছিল বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের ন্যাক্কারজনক কালো অধ্যায়- রেফারিং বিতর্ক! বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালের আনন্দ-উত্তেজনা বিদায় নিয়েছিল অলিম্পিকো থেকে। পক্ষপাতদুষ্ট আর বাজে রেফারিং করে সেদিন বিশ্বকাপ ফুটবলের গায়ে কালিমা লাগান মেক্সিকান রেফারি এডগার্ডো কোডসাল।

১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে মাত্র দুই ম্যাচ খেলে বহিষ্কৃত হন ম্যারাডোনা। এর পরে আর আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দিয়ে মাঠে নামেননি। এ ঘটনার তিন বছর আগে ইতালিতে ড্রাগ টেস্টে তার শরীরে কোকেইনের অস্তিত্ব পাওয়া গেলে ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হন ম্যারাডোনা। স্বাভাবিক বয়সে (৩৭) ফুটবলকে বিদায় জানালেও ম্যারাডোনার কীর্তি কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে মাদকাসক্তির কারণে। বুট জার্সি তুলে রাখলেও মাদক ছাড়তে পারেননি এ কিংবদন্তী। তবে, মাদকের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ে সফল হয়ে জীবন সম্পর্কে নতুন করে জেনেছেন তিনি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে বেঁচে এসে জানিয়েছেন সেই অনুভূতির কথা- ‘যখন আমি কোমায় ছিলাম, তখন আমার মেয়ে প্রার্থনা করছিল যেন তার জন্য বেঁচে থাকি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ কারণ তিনি তার কথা শুনেছেন এবং আমাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।’ ম্যারাডোনা বলেছেন, ‘মাদক ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা- এটা মেরে ফেলে। আমি ভাগ্যবান যে এখানে আপনার সঙ্গে কথা বলছি। যদি এটা চালিয়ে যেতাম তাহলে আমি মারা যেতাম, কোনো সন্দেহ নেই। ১৩ বছর হলো মাদক ছেড়েছি এবং খুব ভালো আছি।’ সূত্র- গোলডটকম

ম্যারাডোনা। ছবি: সংগ্রহ।

২০০০ সালে ফিফার শতাব্দীর সেরা ফুটবলার নির্বাচনে ম্যারাডোনা পেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি ভোট। দ্বিতীয় স্থানে থাকা পেলে তখন অবাক হয়ে বলেছিলেন, ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী সম্মানিত হওয়ার মতো মহত্ব ম্যারাডোনার আছে কি না, তা নিয়ে তার সংশয় রয়েছে। ২০১৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে স্পেশাল অলিম্পিক আয়োজনে বাংলাদেশের ফুটবলাররা সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন এই কিংবদন্তির। পরে ওই বছরের ১৫ মার্চ ম্যারাডোনা তার ফেসবুকের টাইমলাইনে একটি পোস্টে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের বন্ধুদের সঙ্গে। যারা ২০১৯ সালে আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত স্পেশাল অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করবেন। তাদের আল ফুজাইরা ক্লাবে আমাদের সঙ্গে অনুশীলনের আমন্ত্রণ জানানো হয়। খেলাধুলা একটি বিস্ময়কর বিষয়। কারণ সবকিছু অতিক্রম করে এটি আমাদের আরো কাছাকাছি এবং একসঙ্গে নিয়ে আসে। সবার জন্য চুম্বন। বিশেষ করে যারা প্রতিদিন তাদের নিজেদের সীমা অতিক্রম করার চেষ্টা করেন।’

ম্যারাডোনা বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আসার সম্মতিও দিয়েছিলেন এই ফুটবল ঈশ্বর। বাফুফে তার আসার যাবতীয় আয়োজনের ব্যবস্থাও নিচ্ছিল। কিন্তু সবকিছুই থমকে যায় ২৫ নভেম্বর। থমকে যায় বিশ্ব। একটি বিয়োগান্তক খবরে দুঃস্বপ্ন নেমে আসে তাবৎ ফুটবল বিশ্বে।

লেখক: সাংবাদিক

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএম

  • সর্বশেষ
  • পঠিত