ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

সব ভুলে যাওয়া: জানতে হবে প্রতিকার

  মুস্তফা মনওয়ার

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০১৭, ১০:৫৫  
আপডেট :
 ২১ নভেম্বর ২০১৭, ১১:১৪

সব ভুলে যাওয়া:  জানতে হবে প্রতিকার

কয়েক মাস ধরে মবিন আহমেদকে অন্য মনস্ক লাগছে। মবিন আহমেদ তার ছদ্মনাম। এ নামেই তিনি বিজ্ঞান ও গনিত নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। মাঝ বয়সী মবিন সাহেব পেশা স্কুলশিক্ষক। তুখোড় শব্দটা তার নামের আগে কিভাবে, কবে জায়গা করে নিয়েছে তা কেউই বলতে পারবে না। পিথাগোরাসের উপপাদ্য তিনি যে ছাত্রকে একবার বুঝিয়েছেন, সে যতো অমেধাবীই হোক কোন দিন ভুলেনি। অথচ দু-তিন মাস ধরে তিনি কিছুই মনে রাখতে পারছেন না। কাউকে বুঝাতেও পারছেন না তার সমস্যার কথা, অথচ সবাই তাকে ভুল বুঝছে। এরই মধ্যে একদিন বাসা থেকে বের হয়ে স্কুলে যাওয়ার পথ ভুলে গেলেন। এদিক-সেদিক ঘুরলেন অনেক সময়। পরে লোকজন বাসায় পৌঁছে দিলো। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিউরোসার্জন জানান, তিনি ডিমেনশিয়া আক্রান্ত। অনেক ওষুধপাতির সাথে বললেন অনেক কথা। ‘এক্সিলন প্যাচ’ নামে স্টিকার টাইপের একটা ওষুধের পাশে লিখলেন-চলবে। প্রতি দিন একটি এক্সিলন প্যাচ বুকে লাগাতে হবে। প্রতিটির দাম দুইশ’ বিশ টাকা, যা মফস্বল শহরের এক স্কুলশিক্ষকের কাছে অনেক টাকা। দিন দিন তার অবস্থার অবনতি হচ্ছে। নিজের অসুস্থতা সম্পর্কেও তিনি এখন আর কিছুই জানেন না।

বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে একজন এবং প্রতি বছরে ৮০ লাখ মানুষ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। চার বছর আগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে এ জাতীয় রোগীর সংখ্যা ৫ কোটি। বর্তমান বিশ্বের ডিমেনশিয়া আক্রান্ত মোট রোগীর প্রায় ৬৫ শতাংশই অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাস করেন। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার নিয়ে বক্তব্য দেন সংরক্ষিত আসনের এক সংসদ সদস্য। তিনি বলেন, দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর একটি অংশ ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। এদিকে, ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতাল নেই। তিনি একটি হাসপাতাল নির্মাণের দাবি জানান। তিনি আরো বলেন, ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরাও প্রতিবন্ধী। তাদের জন্যও নীতিমালা করা খুবই প্রয়োজন।

ডিমেনশিয়া কি? ডিমেনশিয়া ল্যাটিন শব্দ dementare, যার অর্থ পাগল করে দেয়া থেকে উদ্ভূত। স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির বুদ্ধি, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব লোপ পায় এবং রোগ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা এ রোগে আক্রান্ত হয় এবং হঠাৎ করেই অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না। তার আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। মস্তিস্কের কোষ সংখ্যা বা নিউরন বয়স বাড়ার সাথে সাথে নির্দিষ্ট হারে কমতে থাকে। বয়সের সঙ্গে শারীরিক রোগব্যাধি মস্তিস্কের ক্ষতি করে যদি স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ভন্ডুল করে দেয়, তবে একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ডিমেনশিয়া বলে। ডিমেনশিয়ার সবচাইতে প্রচলিত রূপ হল আলঝেইমার রোগ।

ডিমেনশিয়ায় কে আক্রান্ত হতে পারে?

সাধারণত ৬০ বছবের ওপরে বয়সের মানুষের ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তে আশঙ্কা বেশি। তবে কমবয়সীরা যে ঝুঁকিমুক্ত তা নয়। যেকোনো বয়সেই এটা হতে পারে। পিতামাতার ডিমেনশিয়া থাকলে ছেলেমেয়েরও হতে পারে যেকোন বয়সেই। অতীতে ডিমেনশিয়াকে বলা হতো ‘বার্ধক্যজনিত সমস্য’ বা ‘সেনেলিটি’। ১৯ শতকের শেষেও ডিমেনশিয়াকে অনেক বড় একটা ক্লিনিক্যাল কনসেপ্ট হিসেবে বিবেচিত হতো; এক্ষেত্রে মানসিক অসুস্থতা, মনোসামাজিক অক্ষমতা বা সিফিলিসের মতো রোগগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা হতো। বিংশ শতাব্দিতে দেখা যায়, এ সমস্যার শঙ্কা বয়সের সাথে বাড়ে, তবে কোন বয়স থেকে শুরু হয় তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তাই বয়স বাড়াকে এর একমাত্র কারণ বলা যায় না।

লক্ষণ ডিমেনশিয়ার ধরন অনুযায়ী লক্ষণ বিভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণভাবে যে লক্ষণগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো-

  • স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া
  • কথা বলার সময় সঠিক শব্দ খুঁজে না পাওয়া
  • অন্যের কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়া
  • দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে না পারা বা ভুলে যাওয়া
  • ব্যক্তিত্ব ও মেজাজের পরিবর্তন
  • মনোযোগ দিতে না পারা ও যুক্তি দানে অক্ষমতা
  • ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন
  • ইমোশনকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে না পারা
  • আচরণে অস্বাভাবিকতা উদ্বিগ্নতা
  • ডিপ্রেশন
  • ঘুমের সমস্যা।

ডিমেনশিয়ার কারণ:

ডিমেনশিয়ার ৪টি প্রধান কারণ নির্ধারণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা:

  • হাইপো-থাইরয়েডিজম
  • ভিটামিন বি-১২ এর অভাব
  • লাইম(Lyme disease) বা এক ধরণের ব্যাক্টেরিয়ার দ্বারা সংক্রামক রোগ
  • নিউরোসিফিলিস

এছাড়াও ডিমেনশিয়ার কিছু কারণ রয়েছে-

  • ডিপ্রেশন
  • ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া
  • অতিরিক্ত মদ্যপান

তবে ডিমেনশিয়ার সর্বপ্রধান কারণ হিসেবে বলা হয় ব্রেইন ড্যামেজ।

মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট হয়ে যাওয়া ডিমেনশিয়ার একটি কারণ।

ছবিসূত্রঃ http://blog.bdnews24.com/wp-content/uploads/2015/05/dementia1.jpg

ডিমেনশিয়ার প্রকারভেদ

বেশ কয়েক ধরনের ডিমেনশিয়া দেখা যায়।

অ্যালঝেইমার (Alzheimer’s disease) : সবচেয়ে কমন ডিমেনশিয়া এটি। প্রায় ৬০-৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি দেখা যায়। এ রোগের শুরুর দিকে আক্রান্ত ব্যক্তি নাম মনে রাখতে পারে না, সাম্প্রতিক ঘটনা মনে রাখতে পারে না। ধীরে ধীরে আরো কিছু সমস্যা দেখা দিতে থাকে; যেমন- চিন্তাধারায় সমস্যা, আচরণে অসামঞ্জস্য, কনফিউশন, কথা বলতে গেলে শব্দ খুঁজে না পাওয়া, স্বগোতোক্তি করা ইত্যাদি। প্রধানত মস্তিস্কের স্নায়ুকোষ নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং স্নায়ুকোষের মৃত্যু এর প্রধান কারণ।

অ্যালঝাইমারে ব্রেইনের মাইক্রোটিউবিউলসে অসামঞ্জস্যতা।

সুস্থ মস্তিস্ক এবং অ্যালঝাইমার আক্রান্ত মস্তিস্কের তুলনা।

ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া (Vascular Dementia) : যুক্তি ও বিচারক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, কোনো একটা কাজ সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় ধাপ অনুসরণ করতে না পারা এ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ বা আঘাতের কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ ধরণের ডিমেনশিয়া অনেকক্ষেত্রে অন্য ডিমেনশিয়াও সৃষ্টি করে মিশ্র ডিমেনশিয়াতে রূপ নিতে পারে।

হৃদপিন্ডের রক্তনালির রোগের ভেতর ভাস্কুলার ডিমেনশিয়াতেও প্রতি বছর অনেকের মৃত্যু হয়।

লিউয়ি বডি ডিমেনশিয়া (Lewy Body Dementia) : স্মৃতি লোপ পাওয়া, চিন্তা ভাবনায় সমস্যা, ভিজুয়্যাল হ্যালুসিনেশন, ঘুমের সমস্যা, স্থবির হয়ে পড়া, মাংসপেশির সচলতা কমে যাওয়া ইত্যাদি এ রোগের লক্ষণ। ব্রেইন করটেক্সে যখন প্রোটিন-আলফা-সাইনুক্লেইন এর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে তখন ডিমেনশিয়া হয়ে থাকে।

লিউয়ি বডি ডিমেনশিয়াতে অ্যালঝাইমার এবং পারকিন্সন রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

ফ্রন্টোটেম্পোরাল ডিমেনশিয়া (Frontotemporal Dementia) : মস্তিস্কের সামনের দিকের (ফ্রন্টাল লোব) এবং সাইডের (টেমপোরাল লোব) নিউরন সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে যার ফলে পারসোনালিটি এবং আচরণে পরিবর্তন এবং ভাষা ব্যবহারে জটিলতা দেখা দেয়।

হান্টিংটন ( Huntington’s disease) : ক্রোমোজোমের ৪ নম্বর জোড়ার একটিতে ত্রুটির কারণে ধীরে ধীরে মস্তিস্কের ডিসঅর্ডার সৃষ্টি হতে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত গতিবিধি, চিন্তায় অসামঞ্জস্য, ডিপ্রেশন এবং মুড চেঞ্জ হতে দেখা যায়।

ডিমেনশিয়ার চিকিৎসা

কী কারণে ডিমেনশিয়া হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে এর চিকিৎসা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখনো এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক স্টেজে ধরা পড়লে ওষুধের মাধ্যমে রোগের লক্ষণগুলোকে কিছুটা উন্নয়ন করা যায়। যেমন: অ্যালঝেইমার এর ক্ষেত্রে ‘ডোনেপেযিল’ কিছুটা কাজ করতে পারে। ডিপ্রেশন থাকলে ‘বেনজোডায়াফিন’ যেমন ‘ডায়াযেপাম’ জাতীয় ওষুধ দেয়া যেতে পারে; তবে এতে হিতে বিপরীত হবার আশঙ্কাই বেশি।

পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা এ রোগে আক্রান্ত রোগীর জন্য সবচেয়ে দরকারি। একটা সময়ে গিয়ে রোগী খাওয়া, ঘুম বা শারীরিক যত্ন নিতেও ভুলে যায়। তখন অন্যের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন পড়ে। তাদেরকে পরিচর্যা করতে হবে একেবারে শিশুদের মতো।

ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ

রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোকে পরিবর্তন করা সম্ভম নয়। তবে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন কীভাবে এই রিস্ককে কমিয়ে আনার পাশাপাশি প্রতিরোধ করা যায়। ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে শুরুতেই খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন প্রয়োজন। রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। প্রতিদিনের ব্যায়াম মস্তিস্কের কোষগুলোকে সতেজ রাখতে সাহায্য করে।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত