চাকরির বাজারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা কী সত্যি পিছিয়ে?
সৈকত তালুকদার
প্রকাশ : ১১ মে ২০১৮, ০৯:১৬
যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন তাদের অধিকাংশই মনে করেন চাকরির বাজারে তারা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের তুলনায় পিছিয়ে আছেন। তাদের এরকম ধারণা হওয়ার পিছনে যিনি এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন নাই, তিনি থেকে শুরু করে আমরা যারা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি বা পড়েছি, তারা কেউই কম দায়ী না। প্রায় সময়ই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নানাভাবে কটাক্ষ করি আমরা সবাই।
অনেকেই মনে করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট বেশি, সিজিপিএ ভালো করা কঠিন, ভালো ভালো বিষয় নাই, লাইব্রেরি নাই, ভালো শিক্ষক নাই, ভালো পরিবেশ নাই ইত্যাদি সমস্যা বিরাজমান থাকায় এখানে যারা পড়ে তারা দিন দুনিয়ার কিছুই জানে না। ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরদিন থেকে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে শুনতে হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কী করবা? বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিন থেকে এসব নেগেটিভ কথা শুনতে শুনতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরাও মনে করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামটাই যেন এক বিশাল সমস্যা। তখন তারা নিজেদের সত্যিকার অর্থেই পিছিয়ে পড়া হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। বিসিএস বা অন্যান্য চাকরির পরীক্ষা দিতে ভয় পান বা হীনমন্যতায় ভোগেন।
কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আপনারা কোনভাবেই অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে নন। আপনাদের চাকরির পরীক্ষা দিতে ভয় পাওয়া বা হীনমন্যতায় ভোগার কোন কারণ নাই। কেন?
কিছু ছাত্র-ছাত্রী অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন এটা যেমন সত্যি, অনেকেই নানা কারণে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ না পাওয়ায়, আবার কেউবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও বাড়ি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে লেখাপড়ার খরচ চালানো কঠিন হবে ভেবে ভর্তি না হয়ে বাড়ির কাছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কোন কলেজে ভর্তি হয়েছেন এটাও তেমনি সত্যি। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মতো ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই আপনারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। যেহেতু ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন এবং পাস করেছেন, সেহেতু আপনি দিন দুনিয়ার কিছু না কিছু জানেন এবং ভালো কিছু করার ক্ষমতা রাখেন। লোকে যা বলে বলুক, আপনি আপনার কাজ চালিয়ে যান।
একেবারেই সেশনজট নাই দেশে এমন বিশ্ববিদ্যালয় আছে কিনা গবেষণার বিষয়। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিষয়ে হয়তো সেশনজট নাই, কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিষয়েই মোটামুটি সেশনজট আছে। সুতরাং সেশনজট শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা নয়। আমি যতটুকু জানি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটও এখন আগের চেয়ে অনেক কম। যতটুকু আছে তাতেও অনার্স পাসের পর চাকরিতে আবেদন করার জন্য আপনি কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ বছর সময় পাবেন। চাকরি পাওয়ার জন্য এই সময়টাই যথেষ্ট। আপনি জেনে অবাক হবেন, চাকরির পরীক্ষায় ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কাটা হলেও সেশনজটের কারণে কোন নম্বর কাটা হয় না। তাই সেশনজটের কথা শুনে হতাশ হলে নিজেরই ক্ষতি।
চাকরির পরীক্ষায় বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে সিজিপিএ কোন ফ্যাক্টর না। শিক্ষাজীবনে একটা তৃতীয় শ্রেণি নিয়েও আপনি দেশের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক ও সম্মানজনক পরীক্ষা বিসিএসে আবেদন করতে পারবেন। আবেদন করতে ভালো সিজিপিএ দরকার নাই, আবার সিজিপিএ যা হয় হোক টাইপের চিন্তা মাথায় আনবেন না। সিজিপিএ ভালো হলে ভালো। কিন্তু সিজিপিএ খারাপ হলেই আপনার লাইফ শেষ এই বাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিন। সিজিপিএ বা রেজাল্ট ভালো হলেই পরীক্ষায় আপনাকে বেশি নম্বর দেয়া হবে না। নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে আপনি খাতায় কী লিখেছেন সেটাই বিবেচনা করা হবে। সুতরাং পরীক্ষার খাতায় কীভাবে ভালো করবেন সেই চিন্তা করুন।
টেকনিক্যাল কিছু পদ ছাড়া প্রায় সব সরকারি চাকরিতেই বিষয়ভিত্তিক কোন চাহিদা নেই। আপনি যে বিষয়েই পড়েন না কেন প্রায় সব সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারবেন। শুধু আবেদনই না, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও বিষয় কোন প্রভাব ফেলে না সেটা প্রমাণ করেছেন আপনারই ক্যাম্পাসের বড় ভাই আব্দুল আউয়াল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস কোর্সে পড়ে ২৯ তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। তাছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিষয়ে অনার্স পড়ানো হয়, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তো এই বিষয়গুলোতে অনার্স পড়ানো হয়। সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের যে অবস্থা আপনারও একই অবস্থা। অযথা দুশ্চিন্তা করা ছেড়ে দিন।
অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো লাইব্রেরি নাই। কথা সত্য। কিন্তু একবার ভাবুন তো সেই লাইব্রেরিতে কি চাকরির গাইড বই থাকে? না, থাকে না। সেখানে থাকে শুধু একাডেমিক বই। শুধু আপনাদের না, চাকরির বই অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরও বাজার থেকে কিনে পড়তে হয়। তাছাড়া আপনি বই কিনে পড়েছেন নাকি ধার নিয়ে পড়েছেন, বাসায় লেখাপড়া করেছেন নাকি লাইব্রেরিতে করেছেন, খাতায় নম্বর দেয়ার সময় পরীক্ষক এগুলো বিবেচনা করবেন না। খাতায় ‘মাল’ আছে কিনা সেটাই বিবেচ্য।
যদিও আমি ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষক নাই’ এই কথার সাথে একমত না, তারপরেও তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, নাই। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো শিক্ষকরা কী ক্লাসে চাকরি কিভাবে পাওয়া যাবে সেসব নিয়ে লেকচার দেয়? দেয় না। তাহলে ভালো শিক্ষকের দোহাই দেয়াটা কী নিজের সাথে প্রতারণা করা না? আপনি ভালো শিক্ষকের নিকট শিখেছেন নাকি নিজে নিজে চেষ্টা করে শিখেছেন, ভাইভায় নম্বর দেয়ার সময় এটা বিবেচনা করা হবে না। আপনি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারলেই তারা খুশি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পারিপাশ্বিক অবস্থা চাকরির প্রস্তুতি নেয়ার অনুকূলে না- এই কথাটা কিছুটা সত্য। যেখানে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রায় সবাই অনেক আগে থেকেই চাকরির ব্যাপারে সচেতন থাকে, সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ছাত্র-ছাত্রীরাই চাকরির ব্যাপারে ততোটাই উদাসীন থাকে। চাকরি নিয়ে আলোচনা করার তেমন একটা ছেলে-মেয়ে পাওয়া যায় না এখানে। বরং কাউকে চাকরির প্রস্তুতি নেয়ার জন্য গ্রুপ স্টাডির কথা বললে উৎসাহ দেয়ার বদলে উল্টো টিপ্পনী কাটে। তবে এতে হতাশ হওয়ার কিছু নাই। ফেসবুকে চাকরির প্রস্তুতি নেয়ার জন্য অনেক গ্রুপ আছে। সেখানে যোগ দিন। চাকরি নিয়ে যাবতীয় বিষয় জানুন, আড্ডা দিন।
চাকরিতে আবেদন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করা লাগলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের জন্য কোন নম্বর দেয়া হয় না। ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, শাহজালাল ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই চাকরি হয় না, চাকরি পাওয়ার জন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরই পরিশ্রম করা লাগে, পড়ালেখা করা লাগে। সুতরাং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটা কোন সমস্যা না। চাকরিতে ভালো করতে নামী বিশ্ববিদ্যালয় লাগে না। চাকরি পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি বাড়ানো দরকার আপনার জানার পরিধি। জানার পরিধি ভালো থাকলে আজ হোক কাল হোক আপনি চাকরি পাবেন।
উপরের আলোচনা থেকে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আপনি যেসব বিষয়কে আমলে নিয়ে নিজেকে পিছিয়ে পড়া ভাবছেন, চাকরি পাওয়ার জন্য এগুলোর তেমন কোন ভূমিকা নাই। ১০ তম বিসিএস থেকে ৩৬ তম বিসিএস পর্যন্ত ক্যাডারদের যদি একটা তালিকা করা হয়, তাতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত ক্যাডার সংখ্যা বেশ ভালো একটা সংখ্যাই হবে বলে আমার বিশ্বাস। তাই আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা হেরে যাওয়ার আগেই হারার মানসিকতা বদলে ফেলে লক্ষ্য স্থির করুন। নিজের মধ্যে সাহস সঞ্চার করুন। লেখাপড়া করে আত্মবিশ্বাস অর্জন করুন।
এসএসসি পাসের পর লোকজন জানতে চেয়েছিল, তোমার রেজাল্ট কী? তখন উত্তর দিতে সংকোচ বোধ করেছিলেন। এইচএসসি পাসের পর যখন প্রশ্ন করেছিল, কোন ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছ? সেটার উত্তরও ঠিকমত দিতে পারেননি। কিছুদিন পর মানুষ প্রশ্ন করবে, কোথায় চাকরি করো? আগে যা হয়েছে হোক, শেষ প্রশ্নের উত্তরটা যেন বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন সেই চেষ্টা করুন। ওস্তাদের মার শেষ রাতে।
লেখক: ৩৬ তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত
জেডএইচ/