ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

ওয়ার্ক ফ্রম হোম- সঙ্কট ও সম্ভাবনার চালচিত্র

  শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন

প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২১, ১৮:১৭

ওয়ার্ক ফ্রম হোম- সঙ্কট ও সম্ভাবনার চালচিত্র

দৃশ্যপট ১- ২৩ বছরের জাকিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ৪র্থ বর্ষে পদার্পণ করেছেন ২০২০ সালে। মার্চ মাসে করোনা আবির্ভাবের পর পরই তাকে আবাসিক হল ছাড়তে হয়েছিলো। পরবর্তীতে অনলাইন ক্লাস শুরু হলেও টিউশনি গুলো হাত ছাড়া হয়ে গিয়েছিলো। এরপর ‘ভিনাস লিমিটেড’ নামক কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ পায়।

বাসায় বসে কাজ করার সুযোগ পেয়ে শুরুতে খুশি হলেও পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ঘরে থেকে কাজ এবং একইসাথে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষায় আংশগ্রহণ করতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন জাকিয়া।

দৃশ্যপট ২- সবে মাত্র ৩২ বছরের আতিয়ার ঘর আলো করে এসেছিলো ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। চাকরিরত ছিলেন তিনি ‘ডট ১০’ নামক ই কমার্স সাইটে। কিন্তু করোনা আবির্ভাবের পর জীবন যেন পাল্টে যায় আতিয়ার। ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ পেয়ে শুরুতে খুশি হলেও পরবর্তিতে সন্তান এবং কাজের বেড়াজালে জীবনের রঙ যেন উধাও হয়ে যাচ্ছিলো।

দৃশ্যপট ৩- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স মাষ্টার্স শেষ করে যেন একটি কাঙক্ষিত চাকরির অপেক্ষায় ছিলো ২৬ বছরের ফারুক। করোনা শুরুর পর চাকরি নিয়ে হতাশ হতে হয়নি। ‘এয়ার এক্স’নামক একটি প্রাইভেট ফার্মে হিসাবরক্ষক হিসাবে যোগদান করে ছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই করোনার প্রকোপ বাড়লে শুরু হয় হোম অফিস। সমসাময়িক পরিস্থিতি চিন্তা করে হোম অফিস শুরু করলেও ফারুকের জন্য কখনোই কাম্য ছিলো না দাপ্তরিক পরিবেশ ছেড়ে বদ্ধ ঘরে বসে অফিসের কাজ করা।

উপরের চিত্রগুলো বর্তমানে আমাদের সমসাময়িক জীবনেরই প্রতিচ্ছবি যেন। ২০২০ সালটা আমাদের জন্য কোনো সুখকর খবর বয়ে আনতে পারেনি। বছরের শুরুতেই করোনা মহামারীর কবলে পরে সারাবিশ্ব।

কোভিড-১৯ ভাইরাসের অস্বাভাবিক বিস্তৃতির কারনে বেশির ভাগ অফিস তাদের কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এসব অফিসিয়াল কাজ পুরোপুরি বন্ধ করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। যার ফলে ‘ঘরে থেকে অফিস’বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম বিষয়টির সাথে আমাদের পরিচিতি ঘটে। বর্তমানে গোটা বিশ্বে প্রায় ৩০ শতাংশ কর্মীই হোম অফিস করছেন। ফ্লেক্সজবসের দশম বার্ষিক জরিপ (জুলাই থেকে আগস্ট ২০২১ এর মধ্যে পরিচালিত) অনুসারে, ৫৮ শতাংশ কর্মী মহামারী পরবর্তী হোম অফিস করতে চান এবং ৩৯ শতাংশ কর্মী কর্মস্থলে কাজের পরিবেশ চান।

জরিপে আরও দেখা গেছে যে হোম অফিস সুবিধার জন্য ৪৪ শতাংশ কর্মী পদত্যাগ করতে, ২৪শতাংশ কর্মী ১০-২০% বেতন হ্রাস এবং ২১% ছুটির সময় ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক। একই সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৭৬শতাংশ কর্মী একমত যে কর্মক্ষেত্রে চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে, যা হতাশা বা উদ্বেগের দিকে পরিচালিত করে এবং ১৭ শতাংশ দৃঢ়ভাবে একমত।

গৃহবন্দী হলেও চলমান জীবনকে তো বন্দী করে রাখা যায় না। তাই প্রযুক্তির বিশ্বে ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের মাধ্যমে সময় নষ্ট করে শহুরে জ্যাম ঠেলে, ভালো কাপড় পরে, অফিসে যাওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলেছে ঠিকই, কিন্তু বাসা থেকে অফিসের কাজে মনোযোগ ঠিক রাখা কঠিন। বাসায় নিজের চিরপরিচিত ও আরামদায়ক পরিবেশে অফিসের কাজ করার অভিজ্ঞতা নতুন।

বিষয়টি অনেকের কাছে এক প্রকার স্বপ্ন, আবার অনেকের কাছে দুঃস্বপ্ন। ঘরে বসে অফিসের কাজ করার ফলে সাধারণত সকালে অফিসের জন্য আলাদাভাবে তৈরি হওয়ার ঝামেলা নেই, যেমন খুশি পোশাকেই থাকা যায়, বসের সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, বিরক্তিকর সহকর্মী নেই, প্রিয়জনদের ফোন বা পরিবারকে সময় দেয়া যায়।

কিন্তু ঘরে বসে কাজের অসুবিধাও অনেক যেমন বাসায় বসে কাজ করার ফলে আপনি যা ইচ্ছা তাই খেতে পারছেন, ফলে বাড়ছে ওজন, যা স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই সুখকর নয়। অফিসকে ঘরের অলস মনমানসিকতা নিয়ে কাজ করতে বসলে কাজের গতি কমে যায়। বাসার বাইরে বের না হওয়ায় অনেকে বিরক্ত হচ্ছেন, ফলে শরীর-মন দুটোই খারাপ হচ্ছে। সংটকালীন সময়ে যারা নতুন যোগদান করেছেন তাদের শেখার পরিধি অনেক কমে গেছে। একই অফিসে দীর্ঘদিন কাজ করার পরও একজন সহকর্মী আরেক সহকর্মীকে চিনতে পারছে না। তারই প্রেক্ষিতে সৃষ্টি হচ্ছে দলগত ভাবে কোন কাজ না করার ইচ্ছাশক্তি। বাসায় থাকার ফলে যেমন নিজের শিশুদের দেখাশোনা করা যায়, আবার তাদের নিয়ে ঝামেলাও পড়তে হয়।

অফিসের কাজ ঘরে বসে করার যতই অভ্যাস থাকুক না কেনো তাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ এবং মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক রুথ স্টক-হমবুর্গ করোনা সংকটে মানসিক ফিটনেস নিয়ে একটি গবেষণার কাজ করছেন ৷ তিনি প্রটেস্টান্ট প্রেস সার্ভিসকে বলেন, গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল হচ্ছে ‘বোর আউট'৷ বা সংকটকালীন সময়ে অফিসে শেখার সুযোগ কমে যাওয়া, হতাশা, উদ্বেগের মতো কারণগুলো মানুষের কার্ডিওভাসকুলার এবং ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করতে পারে৷

বর্তমানে ওয়ার্ক ফ্রম হোম এর নেতিবাচক দিক অনেক। যেহেতু এর থেকে পরিত্রাণ এখনি সম্ভব নয় তাই যোগসূত্র বের করে এর সাথে বন্ধুত্ত্ব স্থাপনই শ্রেয়। কিছু উপায় অবলম্বন করলে এর নেতিবাচক দিক থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ সম্ভব। এই অনিশ্চিত সময়ে, এ ধরনের পরিবেশে কাজ করতে সবাইকে একে অপরের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে, বাড়িয়ে দিতে হবে সহায়তার হাত। সময়ের কাজ সময়ে শেষ করে বাসার ও অফিসের কাজে শৃঙ্খলা রক্ষা করা খুবই জরুরি। নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। দীর্ঘ সময় বসে থাকার ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি যেহেতু বাড়ছে, তাই নিয়মিত করা উচিত কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়েম।

অফিসের কাজের সময়ে সহকর্মীদের সাথে ভার্চুয়াল আলোচনায় প্রকাশভঙ্গি বোঝা না যাওয়ায় ভুল বোঝাবুঝির অনেক অবকাশ থাকে। তাই নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আবার যাদের এই অভ্যাস নেই, তারা পড়ে যায় বিষন্নতায়। চোখের আড়াল তো মনের আড়াল বলেও একটা বিষয় আছে। এ ক্ষেত্রে ‘ভিডিও কল’ করে কর্মকর্তা-সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখা অত্যন্ত কার্যকর।

এই মহামারীতে ভয় নয়, সচেতনতাই দিতে পারে স্বাভাবিক জীবনযাপন। আর বর্তমান পরিস্থিতি বা ঘরে বসে অফিস করার কারণে কেউই আশপাশে নেই। কাজের ফাঁকে সামান্য হাস্যরস, রসিকতা, আড্ডাগুলোও নেই। তাই সহকর্মীদের সাথে স্কাইপ, হোয়াটস অ্যাপ প্রভৃতি প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ করে নিজেকে এবং অন্যকে সতেজ রাখা যায় সহজেই।

এই মহাদুর্যোগকে অভিশাপ মনে না করে সচেতনভাবে প্রযুক্তির দক্ষতা বাড়ানোর এইটাই উপযুক্ত সময়। হতাশাগ্রস্ত না হয়ে, এ সময়কে দুঃস্বপ্ন না ভেবে সবাই সচেতন হই এবং অন্যকে সচেতন করি। সময় নষ্ট না করে আনন্দচিত্তে সহজভাবে সবাই একসাথে কাজ করি। নতুন পরিবর্তিত প্রযুক্তির পৃথিবীর জন্য নিজেকে প্রস্তুতি করি।

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত