ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

প্রাথমিক শিক্ষকরা ‘বেশি বেতন পায়’ কথাটি ষড়যন্ত্রের

  মো. সিদ্দিকুর রহমান

প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১১:২৮

প্রাথমিক শিক্ষকরা ‘বেশি বেতন পায়’ কথাটি ষড়যন্ত্রের

প্রাথমিক শিক্ষা সব শিক্ষার ভিত্তি। প্রাথমিকের গণ্ডি পার হয়ে শিক্ষিত খেতাব পেতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষকরা শিক্ষিত নাগরিক তৈরির প্রথম শিক্ষক। ছোট শিশুকে নিয়ে পুরো পরিবার থাকে ব্যস্ত ও সতর্ক। সবার দৃষ্টি থাকে শিশুর ওপর। সে অবুঝ শিশুকে অনেকটা প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করা যায়। অসংখ্য শিশুর মধ্যে থাকে প্রাথমিক শিক্ষকের অবস্থান।

তাদের মানব শিশুতে রূপান্তরিত করার কঠিন কাজটি প্রাথমিক শিক্ষকরা করে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষকরা একনাগাড়ে বিরতিহীনভাবে সকাল ৯টা থেকে বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত পাঠদান করে থাকেন।

এ সময়ের পর হোম ভিজিটসহ তাদের অসংখ্য পাঠদানবহির্ভূত কাজ করতে হয়। উচ্চবিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য কোনো সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীর পাঠদানবহির্ভূত কাজ নেই।

শিক্ষক সংকটের দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে অনেক সময় দৌড়ের ওপর একসঙ্গে একাধিক ক্লাস করতে হয় প্রাথমিক শিক্ষকদের। এ সংকট দূরীকরণে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ নেই; বরং শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণ বেড়েই চলছে।

শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার পরপরই আবার সৃষ্টি হয় শূন্য পদ। প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেকটা ‘নদীর একূল ভাঙে, ওকূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা’ গানের মতো। প্রাথমিকে অসংখ্য কর্মকর্তাসহ ১১ ধরনের কমিটির ‘দেখভালে’ প্রাথমিক শিক্ষকরা হয়ে পড়েন দিশেহারা।

এতদসত্ত্বেও প্রাথমিক শিক্ষা ছুটে চলেছে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতির পথে। চ্যালেঞ্জ করে বলতে হয়, বর্তমানে প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ব্র্যাক কিন্ডারগার্টেন হাইস্কুলের প্রাথমিক শাখার শিক্ষার্থীর চেয়ে জ্ঞান অর্জনে অনেক এগিয়ে। এর প্রধান কারণ, শিক্ষাবান্ধব সরকারের শিক্ষা নিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ ও তরুণ মেধাবী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকদের আন্তরিক প্রয়াস; বিশেষ করে, বর্তমান প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের আন্তরিক উদ্যোগে বিগত সময়ের তুলনায় শিক্ষকদের নিয়মিত ও সময়মতো আগমন-প্রস্থান অনেকটা সফলতা লাভ করেছে। সব ধরনের অনিয়ম প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষায় এখন সুবাতাস বইছে।

এ সত্ত্বেও মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইদানীং প্রদত্ত বক্তব্যে প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের মাঝে চরম হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তাদের ক্ষোভ প্রসঙ্গে কাঙালিনী সুফিয়ার গানের ভাষায় বলতে হয় ‘বুড়ি হইলাম তোর কারণে।’

মাননীয় প্রতিমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষকদের ব্র্যাকের শিক্ষকদের সঙ্গে ভগ্নাংশের অবতারণা করে শুধু শিক্ষক সমাজকে হেয় করেননি; শিক্ষাবান্ধব সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিজেকে সমালোচনার মাঝে ঠেলে দিয়েছেন।

ব্র্যাকে কর্মরত শিক্ষকরা স্বল্পসময় শিক্ষাদান করে থাকেন। তাদের শিক্ষক সংকট ও পাঠদানবহির্ভূত কোনো কাজের চাপ নেই। ব্র্যাক এ দেশের দরিদ্র জনগণের শিক্ষার জন্য কাজ করে আসছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণে ব্র্যাকের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

ব্র্যাকের শিক্ষকমণ্ডলী এসএসসি, এইচএসসি পাস হলেও জবাবদিহিতার মাঝে তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তদুপরি ব্র্যাকের শিক্ষকদের যত সাফল্যই থাকুক না কেন, কোনো অবস্থাতে প্রাথমিকের বর্তমানের এক দশকের সাফল্যের সঙ্গে তুলনা করা সঠিক নয়।

তবে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ব্র্যাকের একজন শিক্ষকের সঙ্গে প্রাথমিকের ৪ জন শিক্ষকের তুলনা করেছেন, তা বোধগম্য নয়। বঙ্গবন্ধু ও শিক্ষাবান্ধব সরকারের জাতীয়করণ প্রাথমিক শিক্ষকদের হেয়প্রতিপন্ন করে ব্র্যাক ও কিন্ডারগার্টেনকে পৃষ্ঠপোষকতা করা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অভিভাবক হিসেবে কতটা যৌক্তিক?

যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের খেলাধুলা ও বইয়ের চাপ কমিয়ে আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষাদানের কথা বলে আসছেন; সেখানে মন্ত্রণালয় কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ের বইয়ের চাপ কমানোর বিষয়ে নীরব থেকে তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।

বেশি বেশি বইকে আমাদের দেশের জনগণ বেশি জ্ঞান অর্জন বলে মনে করে। তারা ভ্রান্ত ধারণার ওপর বিশ্বাস করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাদের সন্তানকে ভর্তি করাতে আগ্রহী না হয়ে বরং সময়সূচির বৈষম্যের ফলে অনুরূপভাবে কিন্ডারগার্টেন, ব্র্যাকসহ বেসরকারি প্রাথমিকে সন্তানদের ভর্তি করিয়ে থাকে।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সমুন্নত রাখা ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব বিপন্নের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কাজ করে যাচ্ছে।

প্রাথমিকের সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বারবার বলে আসছেন, প্রাথমিক শিক্ষকরা বেশি বেতন পান। প্রাথমিক শিক্ষকরা বর্তমান সরকারের আমলে অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর ন্যায় বর্ধিত হারে বেতন পেয়ে থাকেন।

সম্মানিত সংসদ সদস্য, মন্ত্রীসহ সবাই বর্ধিত বেতন পেয়ে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-বৈষম্যের দাবিকে আড়াল করার অভিপ্রায়ে ‘বেশি বেতন পায়’ বক্তব্য ষড়যন্ত্রের অংশ।

মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, আপনার ভগ্নাংশের অঙ্কে প্রাথমিক শিক্ষকসহ প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সবার অন্তরে রক্তক্ষরণ হয়েছে। প্রাথমিকে শিক্ষার উন্নয়নে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

শিক্ষাবান্ধব সরকারের পাহাড়সম সাফল্যকে হেয় করে আপনি অহেতুক ব্যর্থতার দায় নিজের ওপর নিয়েছেন। শিক্ষকের মর্যাদার সঙ্গে শিক্ষার উন্নয়ন জড়িত। হয়তো গুটিকয়েক শিক্ষকের জন্য মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর এ ভগ্নাংশের ধারণা।

তারা আপনারই মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মরত। তাদের যথাযথভাবে ঠিক করার দায়িত্বে আপনি সফলতা অর্জন করতে পারেননি। কারও ব্যর্থতার দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষাবান্ধব সরকারকে বিতর্কিত করা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। অসংখ্য সফলতার মাঝে শিক্ষাবান্ধব সরকারের বিশাল অর্জন ক্ষুণ্ন হতে পারে না।

বাস্তবে কারও যোগ-বিয়োগে শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে না। মর্যাদা হ্রাস পাবে তাদের কর্মে। মুজিববর্ষের অঙ্গীকার ‘শিক্ষক হোক জ্ঞান প্রসারের হাতিয়ার’। শিক্ষক সম্পর্কে সবার মধ্যে ভালোবাসা জাগ্রত হোক, এটাই প্রত্যাশা।

সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত